প্রকৃতির বিস্ময় আলীকদমের ‘দামতুয়া ঝরনা’


Momtaj Uddin Ahamad প্রকাশের সময় : নভেম্বর ২০, ২০২৪, ২:৩৬ অপরাহ্ন /
প্রকৃতির বিস্ময় আলীকদমের ‘দামতুয়া ঝরনা’

।। মমতাজ উদ্দিন আহমদ ।।

পার্বত্যাঞ্চলের প্রাচীন জনপদ আলীকদমের সবুজাভ অরণ্যের ভাঁজে ভাজে লুকিয়ে আছে অসংখ্য গিরিনির্ঝর ও ঝর্ণা-জলপ্রপাত। এরমধ্যে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর পাশাপাশি দেশের পর্যটকদের নজর কেড়েছে ‘দামতুয়া ঝর্ণা ও ব্যাঙজিরি জলপ্রপাত’।

প্রকৃতির অপরূপ নিদর্শন এ ঝর্ণা ও জলপ্রপাতের উপচেপড়া ভরা যৌবন দেখার মোক্ষম সময় বাংলা বর্ষপঞ্জির দ্বিতীয় ঋতু-আষাঢ়-শ্রাবণে। তবে এ দু’মাসে বর্ষাকাল ব্যাপৃত থাকলেও বর্ষার আগের ঋতু রৌদ্রতপ্ত গ্রীষ্ম কিংবা বর্ষার পরের ঋতু শ্যামল শরৎকালেও এই নান্দনিক ঝর্ণার প্রবাহ থাকে অটুট।

শুধু দামতুয়া ঝর্ণাই নয় বর্ষায় বাংলাপ্রকৃতির সব ঝর্ণা-জলপ্রপাতেই টিকরে পড়ে যৌবন স্র্রোত! তেমনিভাবে সবুজ পাহাড়ের অন্তর্বিহীন মৌন নিস্তব্ধতায় দামতুয়া ঝর্ণা যেন আছল বিছিয়ে দেয় পর্যটকদের অভ্যার্থনা জানাতে! তাই সবুজের টানে প্রাণের উচ্ছ্বাসে দেশের নানাপ্রান্ত থেকে প্রতিনিয়ত দামতুয়া দেখতে ছুটে আসেন পর্যটকরা।

দামতুয়া ঝর্ণার নামকরণ:

মুরুং ভাষায় দামতুয়া ঝর্ণার পুরো নাম ‘তুক-অ-দামতুয়া’। ‘তুক’ অর্থ ব্যাঙ এবং ‘অ’ অর্থ ঝিরি। ‘দাম’ অর্থ মাছ আর ‘তুয়া’ অর্থ খাড়া আকৃতির দেয়াল। এ ঝিরিতে একসময় প্রচুর ব্যাঙ পাওয়া যেতো। তাই ঝিরির নাম- ‘তুক-অ’ বা ব্যাঙ ঝিরি।

অপরদিকে, ‘দামতুয়া ঝর্ণা’র পানি একটি খাড়া দেওয়াল বেড়ে নিচে নেমে পড়েছে। খাড়া দেওয়ালের কারণে ‘দাম’ বা মাছ ‘তুয়া’ অর্থাৎ খাড়া দেওয়ালের কারণে উপরে উঠতে পারে না। তাই এ ঝর্ণার নাম মুরুং ভাষায় ‘ তুক-অ-দামতুয়া’। সংক্ষেপে ‘দামতুয়া’।

ব্যাঙঝিরি জলপ্রপাত

অবস্থান:

ঝর্ণাটি আলীকদম উপজেলার চৈক্ষ্যং ইউনিয়নের গহীন অরণ্যের মধ্যে অবস্থিত। আলীকদম-থানচি সড়কের ১৭ কিলোমিটার পয়েন্টের আদু মুরুং পাড়া থেকে ৬/৭ কিলোমিটার দুরে দামতুয়া ঝর্ণা ও ব্যাঙঝিরি জলপ্রপাতের অবস্থান।

প্রকৃতির বিস্ময়:

সুবিশাল পাহাড়ি প্রকৃতির মাঝে থাকা এ ঝর্ণা ও জলপ্রপাতটি পর্যটকদের নজরে আসে ২০১৭ সালের শেষের দিকে। পাহাড়-নদী ও ঝর্ণায় ট্রেকিং করা অনেক পর্যটক জানিয়েছেন ‘দামতুয়া ঝর্ণা’টি প্রকৃতির বিস্ময়। এ ঝর্ণর আকার আকৃতি ও গঠনশৈলী মনোমুগ্ধকর। পার্বত্যাঞ্চলের অন্যান্য নান্দনিক ঝর্ণার দিক দিয়ে নিঃসন্দেহে ঝর্ণাটি অন্যতম।

দামতুয়া ঝর্ণার কয়েকশ’ গজ উপরে ব্যাঙঝিরি জলপ্রপাতটিও খুবই মনোহর। এ জলপ্রপাতের পাথুরে মাটির ধাপগুলো বিস্ময়কর। যেন সুদক্ষ রাজমিস্ত্রির নিপুন হাতে সৃষ্ট কোন আল্পনা! এ জলপ্রপাতের অনেকগুলো বিচ্ছিন্ন ধাপ প্রমাণ করে এটি প্রকৃতির খেয়ালে গড়া অসাধারণ একটি স্থাপত্যশৈলী!

‘দামতুয়া ঝর্ণা’য় দু’দিকের খাড়া পাহাড়ি দেয়াল বেয়ে কলকল, ঝম্ঝম রবে সুরের অনুরনণ তুলে উন্মাতাল স্র্রোত গড়িয়ে পড়ছে নিচের গভীর জলাশয়ে। পাহাড়ের নিস্তব্ধতা যেন সেখানে ম্লান। উঁচু থেকে পড়া পানির কিছু অংশ আবার জলীয় বাষ্প হয়ে বাতাসে মিশে সেখানে এক ধোঁয়াশাপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। এ যেন পাহাড়ের গভীরে মেঘমালা!

‘দামতুয়া ঝর্ণা ও জলপ্রপাতে’ পৌঁছার আগে দেখা মিলবে ‘ওয়াংপা ঝর্ণা’। মূল ‘ওয়াংপা ঝর্ণা’ দেখতে হলে খাড়া পাহাড় বেয়ে নীচে নামতে হয়। চলাচল পথের মাঝে অসংখ্য ছোট বড় পাথরের ভাজে শীতল জল যেন জানান দেয় ওয়াংপা ঝর্ণা জল¯্রােত কেমন হবে। ওপর থেকে ‘ওয়াংপা ঝর্ণা’র পানি গড়িয়ে পড়ার দৃশ্য আরো মনোহর লাগে।

প্রকৃতির নান্দনিক তুলিতে আঁকা সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হচ্ছে ভ্রমণপিয়াসী মানুষ। রাতে যদিও সেখানে অবস্থান করা নিরাপদ নয়। তবে ভরা পূর্ণিমায় তাবু খাটিয়ে অবস্থান করলে বুঝা যাবে রবীন্দ্রনাথের ভাষায়- ‘কৃষ্ণপক্ষের কৃশ চাঁদ যেন রোগশয্যা ছেড়ে ক্লান্ত হাসি নিয়ে অঙ্গনে বাহির হয়ে এল’।

রাতের বেলায় চাঁদের আলোয় ঝর্ণার অপরূপ সৌন্দর্য ও কলতান মুগ্ধ হন যে কেউ! সেখানে প্রকৃতি খেলা করে আপন মনে। রুমুঝুম্ ঝুম্ ঝুম্ শব্দে বয়ে চলা ঝর্ণাধারায় গা ভিজিয়ে মানুষ যান্ত্রিক জীবনের অবসাদ থেকে নিজেকে ধুয়ে সজীব করে তুলে এ ঝর্ণার হিমশীতল পানি।

অনাদিকাল থেকেই প্রবাহিত হচ্ছে এসব ঝর্ণা ও জলপ্রপাত। এতদিন সড়ক যোগাযোগ না থাকা, বিচ্ছিন্ন পাহাড়ি জনপদ হওয়ায় তা ছিল লোকচক্ষুর অন্তরালে। উদ্যমী তরুন-যুবকরা পাহাড়ের কন্দরে লুকিয়ে থাকা এসব ঝর্ণা রাণী ও জলপ্রপাতকে খুঁজে খুঁজে বের করে আনছে। ফলে পাল্টে যাচ্ছে আলীকদম উপজেলার পর্যটন পরিবেশ। নতুত্বের ছোঁয়া লাগছে পর্যটনখাতে। সরকারি আনুকুল্য পেলে এসব পর্যটন স্পট হয়ে উঠবে পর্যটকবান্ধব।

কিভাবে যাবেন:

ঢাকা-চট্টগ্রাম থেকে সরাসরি বাসে সহজেই এখন আলীকদম আসা যায়। আলীকদম-থানচি সড়কের ১৭ কিলোমিটারের আদু মুরুং পাড়ায় নেমেয় ২/৩ ঘন্টা পাহাড়ি পথ হাঁটতে হয়। এরপর দামতুয়া ঝর্ণার দেখা মেলে। ‘দামতুয়া ঝর্ণা’য় নামতে হলে খাড়া পাহাড়ের কিছুটা পথ ডিঙ্গিয়ে নীচে নামতে হয়। পাশের জলপ্রপাতের মাটি পাথুরে। সেখানে নামতে তেমন সমস্যা হয় না। ঝর্ণা ও জলপ্রাপাতের নীচে মাঝারী ধরণের জলাশয় আছে।

থাকার জায়গা :

আলীকদমে উপজেলা থাকার জন্য দামতুয়া, অর্কিড, মারাইংতং রিসোর্ট, রূপমুহুরী রিসোর্টসহ সরকারি রেস্ট হাউজ রয়েছে।

বিশেষ পরামর্শ:

* ঝর্ণা পর্যন্ত যেতে গাইড নিলে সুবিধা হয়। * প্লাস্টিক বর্জ্য নির্দ্ধিষ্ট স্থানে রাখুন। * শিশু, বয়স্ক বা অপ্রাপ্তবয়স্কদের সেখানে না নেওয়ায় সঙ্গত। * পাহাড়ের আঁকা বাঁকা পথে সারিবদ্ধভাবে চলাচল করুন। * পাহাড়ের পরিবেশ ও প্রকৃতির ক্ষতিসাধন করবেন না। * উচ্চস্বরে আওয়াজ দিবেন না, এতে পাহাড়ের প্রাণ-প্রকৃতির ক্ষতি হয়। * আপনার যে কোন অভিযোগ ও পরামর্শ স্থানীয় প্রশাসনকে অবিহিত করুন। * বর্ষায় পাহাড়ি পথে জোঁক থাকতে পারে, তাই সতর্ক থাকুন।

লেখক: মমতাজ উদ্দিন আহমদ, সভাপতি, আলীকদম প্রেসক্লাব, মোবাইল: ০১৫৫৬৫৬০১২৬।