।। মমতাজ উদ্দিন আহমদ ।।
১৯৯৮ খ্রিস্টাব্দ। এ বছরটি গিরিনন্দিনী আলীকদম উপজেলার জন্য একটি স্মরণীয় বছর। এ বছরের শুরুর দিকে গোড়াপত্তন হয় ‘আলীকদম প্রেসক্লাব’।
‘সাংবাদিকতা দেশ ও জাতীর কল্যাণে নিবেদিত’ স্লোগানটি ছিল আলীকদম প্রেসক্লাব প্রতিষ্ঠালগ্নের মূলপ্রতিপাদ্য।
দেশের দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তে অবস্থিত পার্বত্য বান্দরবান জেলার অন্তর্গত আলীকদম উপজেলায় ১৯৯৮ খ্রিস্টাব্দে ‘আলীকদম প্রেসক্লাব’ এর যাত্রা শুরু হয়েছিল। এ যাত্রালগ্নের প্রথম দিককার সারথী ছিলেন সাংবাদিক মোঃ কামরুজ্জামান, সাংবাদিক আবু শামা, সাংবাদিক উচ্চতমনি ও সাংবাদিক মমতাজ উদ্দিন আহমদ প্রমুখ।
হাঁটি হাঁটি পা পা করে গত ৩০ মার্চ আলীকদম প্রেসক্লাব প্রতিষ্ঠার ২৫ বছর পার হয়েছে। বর্তমানে প্রতিষ্ঠার ২৬ বছরে পা দিয়েছে আলীকদম প্রেসক্লাব!
মফস্বলে একটি প্রেসক্লাব এর দীর্ঘ দু’যুগ সময় পার করা চাট্টিখানি কথা নয়। দীর্ঘ এ পথ-পরিক্রমায় আলীকদম প্রেসক্লাব তিন পার্বত্য জেলাসহ সারাদেশে মফস্বল সাংবাদিকতায় অনন্য দৃষ্টান্ত রেখে চলেছে।
আলীকদম প্রেসক্লাবের রয়েছে নিজস্ব জমি ও ভবন। সারাদেশে উপজেলা পর্যায়ে এ ধরণের নিজস্ব সম্পদ ও স্থাপনা নিয়ে খুব কম প্রেসক্লাবই রয়েছে।
১৯৯৮ খ্রিস্টাব্দের ৩০ মার্চ আলীকদম প্রেসক্লাবের যাত্রা শুরু হয়। প্রথম এ কমিটির সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক ও কোষাধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন সাংবাদিক আবু শামা, মোঃ কামরুজ্জামান ও মমতাজ উদ্দিন আহমদ।
১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দের ৩০ আগস্ট তৎকালীন থানা নির্বাহী অফিসার (টিএনও) ইকবাল মাহমুদের সাথে প্রেসক্লাবের অফিস ঘর সংক্রান্ত বৈঠক করেন মোঃ কামরুজ্জামান ও মমতাজ উদ্দিন আহমদ। এ সময় টিএনও ইকবাল মাহমুদ উপজেলা পরিষদ সম্মুখস্থ ‘উপজেলা গণপাঠাগার’কে প্রেসক্লাবের অস্থায়ী কার্যালয় হিসেবে ব্যবহার করার অনুমতি দেন। সেই থেকেই আলীকদমে মাঠ সাংবাদিকতার সুতিকাগার প্রেসক্লাবের আনুষ্ঠানিক অফিসিয়াল কার্যক্রম শুরু হয়।
বিগত ২৫ বছর পূর্বেই মফস্বল তথা মাঠ সাংবাদিকতাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে অবদান রাখেন সাংবাদিক মোঃ কামরুজ্জামান, সাংবাদিক মমতাজ উদ্দিন আহমদ, সাংবাদিক আবু শামা ও সাংবাদিক সাংবাদিক উচ্চতমনি তঞ্চঙ্গ্যা প্রমুখ। এ সময় সাংবাদিকদের সহযোগি ছিলেন আলীকদম উপজেলার প্রথম পত্রিকা এজেন্টের মালিক জসিম সরওয়ার। সাংবাদিকদের প্রতি তাঁর সার্বিক সহযোগিতা ছিল তখন অবারিত।
৭ মার্চ ২০০০ খ্রিঃ তারিখ প্রেসক্লাবের সভায় প্রেসক্লাব এর নিজস্ব ঘর/ভবন নির্মাণে ক্লাবের নামে নিজস্ব জমি বন্দোবস্তির বিষয়ে পুণঃপ্রস্তাব রাখেন সাংবাদিক মমতাজ উদ্দিন আহমদ। এ প্রস্তাবের প্রেক্ষিতে সাংবাদিক মোঃ কামরুজ্জামান সভায় অবহিত করেন যে, টিএনও ও হেডম্যানের সাথে আলাপ হয়েছে। তিনি বলেন, উপজেলার পুরাতন স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সামনে সরকারি রাস্তা ও বাজার সন্নিহিত জায়গাটি ক্লাবের নামে বন্দোবস্তির প্রস্তাব নেয়া হচ্ছে। তখন থেকে এ জমি বন্দোবস্তির জন্য টিএনও, হেডম্যান ও কানুনগোর সাথে যোগাযোগ রক্ষা করেন তৎকালীন সেক্রেটারী মোঃ কামরুজ্জামান।
আলীকদম প্রেসক্লাবের ৪ এপ্রিল ২০০০ খ্রিঃ তারিখের সভায় সাংবাদিক মোঃ কামরুজ্জামান জানান, জায়গাটি ইতোমধ্যে ক্লাবের অনুকুলে হেডম্যান রিপোর্ট নিয়ে প্রশাসনিকভাবে বন্দোবস্তির আবেদন রুজু করা হয়েছে।
২০০০ সালের জুন-জুলাইয়ে নিজস্ব জমিতে এডিপির ৭৮ হাজার টাকা বরাদ্দে আলীকদম প্রেসক্লাবের টিনসেট ঘর নির্মাণ হয়। ২০০১ সালের ৩০ জানুয়ারী ক্লাব ঘর উদ্বোধন করেন থানা নির্বাহী অফিসার (টিএনও) ইকবাল মাহমুদ।
২০০৪ সালের শেষের দিকে বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদের অর্থায়নে ত্রিতল ফাউন্ডেশনবিশিষ্ট “প্রেসক্লাব ভবন” নির্মাণের জন্য প্রথম দফায় ২ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা বরাদ্দ পাওয়া যায়। পরবর্তীতে অসমপ্ত ভবন নির্মাণে আরো বরাদ্দ দেয় জেলা পরিষদ।
১৯৯৮-২০০০ সালের মধ্যে আলীকদম প্রেসক্লাব প্রতিষ্ঠা ও নিজস্ব অফিসঘর নির্মাণে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখেন সাংবাদিক মোঃ কামরুজ্জামান। পাশাপাশি তাঁর সহযোগি ছিলেন আবু শামা, উচ্চতমনি তঞ্চঙ্গ্যা ও মমতাজ উদ্দিন আহমদ প্রমুখ।
আলীকদম প্রেসক্লাব প্রতিষ্ঠার ২ বছর পর (১৫/০১/২০০১ খ্রিঃ) নতুন সদস্য হিসেবে যুক্ত হন দেশমনি তঞ্চঙ্গ্যা, জগদীশ তঞ্চঙ্গ্যা ও আবু সৈয়দ প্রমুখ। পরের বছর সদস্যপদে যুক্ত হন এসএম আজিজ। কিন্তু এক বছরের মধ্যেই গঠনতন্ত্র অনুসারে আবু সৈয়দের এবং পরবর্তীতে এসএম আজিজের সদস্যপদ বিলুপ্ত হয়।
১৯৯৮-২০০১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত পর্যায়ক্রমে আলীকদম প্রেসক্লাবের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন সাংবাদিক আবু শামা ও (টিএনও) ইকবাল মাহমুদ। এ সময় সাধারণ সম্পাদক হিসেবে সাংবাদিক মোঃ কামরুজ্জামান ও কোষাধ্যক্ষ হিসেবে মমতাজ উদ্দিন আহমদ দায়িত্ব পালন করেন।
২০০২ সাল থেকে ২০১০ খ্রিঃ পর্যন্ত সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন সাংবাদিক মোঃ কামরুজ্জামান ও মমতাজ উদ্দিন আহমদ।
২০১১ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন মেয়াদে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন মমতাজ উদ্দিন আহমদ ও দেশমনি তঞ্চঙ্গ্যা প্রমুখ।
প্রোক্ত সাংবাদিকদের নেতৃত্বকালীন সময়েই আলীকদম প্রেসক্লাবের নিজস্ব জমিতে গড়ে তোলা হয় বহুতল ফাউন্ডেশনবিশিষ্ট প্রেসক্লাব ভবন।
২০২০ সাল থেকে আলীকদম প্রেসক্লাবের সভাপতি ও ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বরত আছেন মমতাজ উদ্দিন আহমদ ও এসএম জুয়েল প্রমুখ।
বর্তমানে সাংবাদিক মোঃ কামরুজ্জামান লামা প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন। সাংবাদিক আবু শামা একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক। তাঁরা দু’জন আলীকদম প্রেসক্লাবের আজীবন সদস্য।
আলীকদম প্রেসক্লাব প্রতিষ্ঠার থেকে এ উপজেলার উন্নয়ন-সম্ভাবনার কথা পত্রিকায় পাতায় পাতায় তুলে ধরেছেন এ ক্লাবের সদস্যরা। অসংকোচ প্রকাশের দূরন্ত সাহস নিয়ে তুলে এনেছেন সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ের উন্নয়ন-চিত্রের সমসাময়িক চিত্র। এরফলে হয়েছেন কর্তাব্যক্তি ও জনপ্রতিনিধিদের রোষানলের শিকার। হয়েছে মামলা-হামলার মুখোমুখি।
প্রেসক্লাব ভবন নির্মাণ করতে গিয়ে ২০০৫ ও ২০০৭ সালে দুইটি মামলার বিবাদী ও আসামী হন তৎকালীন প্রেসক্লাব সভাপতি মোঃ কামরুজ্জামান ও সাধারণ সম্পাদক মমতাজ উদ্দিন আহমদ। এরমধ্যে ২০০৭ সালের ফৌজদারী মামলা থেকে এ দু’জন বেকসুর খালাস পেলেও ২০০৫ সালে প্রেসক্লাবের ভূমি নিয়ে করা মামলাটি বর্তমানে বিজ্ঞ আদালতে এখনো বিচারাধীন!
প্রতিষ্ঠার পর থেকে আলীকদম প্রেসক্লাব গতানুগতিক কোন সংগঠনের মতো ‘নাম-সর্বস্ব’ প্রতিষ্ঠান হয়ে থাকেনি। বরং প্রান্তিক-মফস্বলীয় সাংবাদিকতায় যোগ করেছে নব দিগন্তের সূচনা। ইতোমধ্যে আলীকদম প্রেসকাবের সদস্যদের কর্মান্ডের পরিধি বৃদ্ধি পেয়েছে।
২০০৮ সালের অমর একুশে বইমেলায় মমতাজ উদ্দিন আহমদ লিখিত ও আলীকদম প্রেসক্লাবের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছে ‘প্রেক্ষণ : পার্বত্য চট্টগ্রাম গিরিনন্দিনী আলীকদম’ শীর্ষক গ্রন্থ। যা আলীকদম উপজেলার ইতিহাস-ঐতিহ্যমূলক একটি প্রামাণ্য গ্রন্থ। ২০১১ সালের অমর একুশে বইমেলায় তাঁর লেখা ‘পার্বত্য চট্টগ্রামের মুরুং উপজাতি’, ২০১৯ খ্রিস্টাব্দে ‘দামতুয়া বান্দরবান ভ্রমণ গাইড’ ও ২০২০ সালের অমর একুশে বইমেলায় প্রকাশিত হয় ‘পত্র-সাহিত্যে নজরুল’ গ্রন্থ।
সংবাদপত্রশিল্পে এ কথা সর্বজনবিদিত যে, মফস্বলে তথা উপজেলা শহরে যাঁরা সাংবাদিকতা করেন, তাঁরা প্রতিনিয়তই নানা বঞ্চনার শিকার হন। কলম সৈনিকের যুদ্ধ করেও সুফল পান না মফস্বলের সাংবাদিকরা। একদশক আগেও কেন্দ্রের সাংবাদিকরা যেখানে তথ্যপ্রযুক্তিতে সমৃদ্ধ ছিল সেখানে মফস্বল সাংবাদিকরা পুরনো প্রযুক্তি নিয়েই সাংবাদিকতা করতেন। আলীকদম প্রেসক্লাবের সদস্যরাও এর ব্যক্তিক্রম নন।
মফস্বল সাংবাদিকতায় প্রশাসন ও হোমরা-চোমরাদের চোখ রাঙানী পদে পদে। সেই সাথে রয়েছে তাৎক্ষণিক কোন ঘটনা প্রবাহের ছবি ও সংবাদ প্রেরণে নানা বিড়ম্বনা। রক্তচক্ষুর ভ্রুকুটি উপেক্ষা করে বিগত দুই দশকের বেশী সময় ধরে মাঠ সাংবাদিকতায় অনন্য নজির স্থাপন করেছে আলীকদম প্রেসক্লাবের সাংবাদিকরা।
আরাকান সীমান্ত পাহাড় থেকে উৎসারিত খরস্রোতা মাতামুহুরী বিধৌত পার্বত্য জনপদ আলীকদম। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে চকরিয়া থেকে আগতরাই এ জনপদের নেতৃত্বের হাল ধরেছিলেন। একইভাবে ১৯৯৮ সালের আগে এ জনপদের খবরাখবর সংগ্রহ ও প্রকাশ করতেন চকরিয়া ও লামার সাংবাদিকরা।
মূলতঃ ১৯৯৮ সালের পর আলীকদমে সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে একটি গৌরবজ্জ্বল ইতিহাসের সূচনা হয়। সময়ের পথ-পরিক্রমায় দুই যুগ পার করেছে আলীকদমের মাঠ সাংবাদিকতা।
আলীকদম প্রেসক্লাবের সাংবাদিকরা দেশের শীর্ষ স্থানীয় বিভিন্ন দৈনিকে সাংবাদিকতায় তাদের যোগ্যতার স্বাক্ষর রাখছে। এখন দেশের প্রায় জাতীয়, আঞ্চলিক ও স্থানীয় সংবাদপত্রে আলীকদম উপজেলার যে কোন চালচিত্রের সংবাদ অতি গুরুত্বের সাথে প্রকাশিত হচ্ছে।
অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে বলিষ্ট লেখনীকে ধারণ করে আধাঁর টুটির বাঁধনকে ছিন্ন করেছেন কলম সৈনিকেরা। এক সময়ের নৈরাজ্যকর সমাজ ব্যবস্থা ও সংঘাতময় রাজনৈতিক পরিস্থিতির মাঝেও লেখনীতে এতটুকুও পিছপা হননি এখানকার সাংবাদিকরা। সতত প্রাণের বন্যায় উজ্জ্বীবিত থেকেছেন তারা।
ফলে এখনো পর্যন্ত মূলধারার সাংবাদিকদের একক সংগঠন ‘আলীকদম প্রেসক্লাব’। ২০০৮ সাল থেকেই আলীকদম প্রেসক্লাবে প্রযুক্তির ছোঁয়া লাগে। হাঁটি হাঁটি পা পা করে এ প্রেসক্লাব এখনো নানা প্রতিবন্ধকতার বেড়াজাল ছিন্ন করে অন্ধকারে আলোর ঝলকানি দিচ্ছে। কিন্তু কিছু কুপমণ্ডুকের ষড়যন্ত্র থেমে নেই!
এ প্রেসক্লাবকে বিতর্কিত করতে ২০১৯ সালের মাঝামাঝি সময় থেকে এ কুপমণ্ডুকের দল আধাজল খেয়ে নেমেছে। আলীকদমের দীর্ঘ দুই দশকের ঐতিহ্য-লালিত মাঠ সাংবাদিকতায় কালিমা লেপনের অপচেষ্টায় ব্যাপৃত হয় এরা। সাংবাদিকতার সুমহান ঐতিহ্যকে ভূলুণ্ঠিত করে তারা অলীক নেতৃত্বের দিবাস্বপ্নে বুদ্ হয়ে মিথ্যা কুহক আর আত্ম প্রচারে বিলাসী সময় পার করছেন। যত্রতত্র আলীকদম প্রেসক্লাবের নাম ব্যবহার করে মিথ্যা পরিচয় দিয়ে সকলকে বিভ্রান্ত করছেন!
তারপরও রবীন্দ্রনাথের ভাষায় বলতে হয় দুইযুগ পূর্বে প্রতিষ্ঠিত আলীকদম প্রেসক্লাব যেন এখনো ‘আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী’।
এ অন্ধকার ভেদ করেই আলীকদম উপজেলার জন্য সত্য-ন্যায়ের বলিষ্ট লেখনীকে ধারণ করেই কর্মতৎপরত অব্যাহত রেখেছেন এ ক্লাবের সদস্যরা। এ কথা এখন সর্বজন বিদিত যে, আলীকদম প্রেসক্লাবের সাংবাদিকদের কর্ম তৎপরতায় সুফল পাচ্ছে এ জনপদের বিশাল জনগোষ্ঠী!
আপনার মতামত লিখুন :