রূপসী তৈনখাল : নিরন্তর অনন্ত আনন্দধারা


Momtaj Uddin Ahamad প্রকাশের সময় : মার্চ ১৯, ২০২৩, ২:৫৭ অপরাহ্ন /
রূপসী তৈনখাল : নিরন্তর অনন্ত আনন্দধারা

। মমতাজ উদ্দিন আহমদ ।

মাতামুহুরী নদীর মহারাজ্যপটে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যে একটি রাজ্য গড়ে তুলেছে এক রূপসী। এই রূপসী বড়ই অভিমানী। কখনো শান্ত-মনোহর, কখনো চপলা-চঞ্চলা! কখনোবা সংহারী, উন্মত্ত-রুদ্র। মৌসুম ভেদে তার রূপ পাল্টায়। আলীকদম উপজেলার দক্ষিণ-পূর্বের সবুজাভ অরণ্যে বড়ই মনোহর সেই রাজ্য। বৈচিত্র্যে ভরপুর তার চারপাশ। থাঙ্কুয়াইন, লাদমেরাগ, পালংখিয়াং, চাইম্প্রা, জাফরুং, ক্রাতং ও শামুক ঝর্ণার উৎপত্তি এই রূপসীর পাড় ধরে। সেই রূপসীর নামটি হচ্ছে ‘তৈনখাল’।

তৈনখাল: বহে নিরন্তর অনন্ত আনন্দধারা

‘তৈনখাল’ খরস্রোতা মাতামুহুরীর একটি উপনদী। পার্বত্য চট্টগ্রামের নৈসর্গিক সৌন্দর্যে মাতামুহুরী নদীর ‘প্রজারূপে’ তৈনখালের বিচরণ। এই রূপসী তৈনখাল চিম্বুক রেঞ্জের পর্বত সারির পশ্চিমে এবং মাতামুহুরী রিজার্ভের পূর্ব দিকের অনুচ্চ পর্বতমালা থেকে উৎকীর্ণ হয়ে এঁকেবেঁকে দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে ঢলে পড়েছে খরস্রোতা মাতামুহুরীর বুকে। এর সংযোগস্থল ঐতিহাসিক আলীর পাহাড়ের কুল ঘেঁষে আলীকদম উপজেলা সদরে। 

তৈনখাল এর নামকরণের ইতিহাস পাওয়া যায় ১৪০০ খ্রিস্টাব্দের গোড়ার দিকের একটি ঘটনায়। প্রায় ২০০ বছর আগে লেখা পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলার প্রথম জেলা প্রশাসক ক্যাপ্টেন টি.এইচ. লেউইন (১৮৩৯-১৯১৬) এর বইতেও তৈনখাল এর নান্দনিক বর্ণনা রয়েছে।

  • নামকরণঃ

তৈনখাল পার্বত্য চট্টগ্রামের দু’টি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী চাকমা ও তঞ্চঙ্গ্যার প্রাচীন ইতিহাসের উপজীব্য। আরকানীদের দ্বারা অত্যাচারিত দৈনাংকরা (তঞ্চঙ্গ্যা) যখন ১৪১৮ খ্রিস্টাব্দে দলপতি মারেক্যা ও তৈন্ সুরেশ্বরীর নেতৃত্বে তৎকালীন অরণ্যভূমি ‘আলীকদম’ আসেন তখন তারা প্রথম নিবাস গড়েছিলেন তৈনখালের পাড়ে।

তৈনখালের পাড়ে বসতি স্থাপিত হওয়ার পর তথায় মৈসাং রাজার কনিষ্ঠ পুত্র তৈন্সুরেশ্বরীর নামানুসারে এই খালের নাম রাখা হয় ‘তৈনছড়ি’। কালের পরিক্রমায় এই তৈনছড়ি’ই ‘তৈনখাল’ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে।

মধাবচন্দ্র চাকমাকৃত শ্রীশ্রী রাজনামা বা চাকমা রাজন্যবর্গ পুস্তিকার বিবরণমতে, মৈসাং রাজা ছিলেন চাকমা রাজবংশের তালিকায় ২০২ তম রাজা। তার পিতা মৈসাং রাজা (মংছুই) ছিলেন ২০১ তম রাজা।

কথিত আছে, রাজা তৈন সুরেশ্বরী বাঁশ বেতের সিংহাসন পেতেছলিনে আলীকদমের তৈনছড়ির মোহনায় মাতামুহুরী নদীর অববাহিকায়।  ক্যাপ্টেন টি.এইচ লেউইন (১৮৩৯-১৯১৬) তাঁর বইয়ে তৈনখালের বানান লিখেছেন ‘টুয়াইন খাইয়ুং’ (Twine Khyoung)।

ব্রিটিশ আমলে তিনি পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলায় ১৮৬৬ খ্রিস্টাব্দে প্রথম জেলা প্রশাসক নিযুক্ত হন।  ১৮৬৭ সালের দিকে তিনি তৈনখাল ভ্রমণ করেন। তৈনখালের অবিমিশ্র মনোরম দৃশ্য দেখে তিনি আভিভূত হয়েছিলেন!

ক্যাপ্টেন টি.এইচ. লেউইনের লেখা ‘THE HILL TRACTS OF CHITTAGONG AND THE DWELLERS THEREIN’ বইটি পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষ ও কতিপয় প্রাকৃতিক স্থানের বর্ণনা সম্পর্কে একটি ঐতিহাসিক দলিল।

বইটিতে তৈনখালের অপরূপ বর্ণনা এসেছে এভাবে-

“I remember once going up the Twine Khyoung, …The stream ran briskly in a narrow pebbly bed, between banks that rose nearly perpendicularly, and so high that the sun only came down to us by glints, here and there. Enormous tree ferns hung over our heads, some 50 feet up, while the straight stems of the “Gurjun” tree shot up without a branch, like white pillars in a temple; plantains, with their broad drooping fronds of transparent emerald, broke at intervals the dark- green wall of jungle that towered up in the background” (Page-3)

(অনুবাদঃ আমার মনে আছে, আমি একবার টুয়াইন খাইয়ুং (তৈনখাল) ধরে ওপরে উঠে যাচ্ছিলাম। এই অসাধারণ চলচঞ্চলা স্রোত নুড়ি পাথরের আঁকাবাঁকা পথ বয়ে চলছিল প্রায় উলম্ব একটি উতরাই পেরিয়ে এসে। সূর্যের আলোর ছিটেফোঁটা শুধু নেমে আসছিল আমাদের চারপাশে, এখানে-সেখানে। বিশাল বৃক্ষ থেকে অনেক ফার্ন বা লতাজাতীয় গাছগুলো ঝুলছিল, অন্তত ৫০ ফুট ওপরে। গর্জনের কাণ্ড একদম সোজা ওপরে উঠে গিয়েছিল যেন কোনো মন্দিরে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা সাদা পিলারগুলোর মতো। নিচের ঘন ঝোপ আর ঝুলন্ত ঝাড় থেকে কোথাও যেন ঠিকরে বের হচ্ছিল স্বচ্ছ পান্নার আলো। চারদিকের গাঢ় সবুজ বন এই আলো-আঁধারিকে চোখধাঁধানো করে তুলেছিল।’) [পাতা-৩]

তথ্যসূত্র: ‘THE HILL TRACTS OF CHITTAGONG AND THE DWELLERS THEREIN’ Page: 3
  • তৈনখালের উৎসঃ

তৈনখালের উৎসের কাছাকাছি পাড়াটির নাম খিদু পাড়া। পাড়ার দক্ষিণে অনতিদূরে তৈনখালের একেবারে উজানের ঝিরিটির নাম হচ্ছে পাইয়্যা ঝিরি। এই ঝিরির ডান দিক হতে আনুমানিক ৫/৬ কিলোমিটার দূরে চিম্বুক রেঞ্জের পর্বতসারি।

চিম্বুক রেঞ্জের পশ্চিমে এবং মাতামুহুরী রিজার্ভের পূর্বাংশে অনুচ্চ যে পর্বতসারি আছে সেখানেই তৈন’র জন্ম বলে জানা যায়। এই অনুচ্চ পর্বতসারি থেকে মাতামুহুরী নদীর আরো অসংখ্য ঝিরি ও খালের জন্ম হয়েছে। তৈনখালের ভূমিঢাল দক্ষিণ-উত্তর থেকে পূর্ব-পশ্চিমে। ভৌগলিক অবস্থানগতভাবে খালটির উৎস আলীকদম উপজেলার দক্ষিণ-পূর্বে।

তৈনখালটি চিম্বুক রেঞ্জের পর্বতসারির পশ্চিমের গা ঘেঁষেই চলেছে। এ রেঞ্জের দক্ষিণ-পশ্চিমের একটি সাবসিডিয়ারি পাহাড়ের ভাঁজের ঝিরি-ছড়া-ঝর্ণার পানি তৈনখালের প্রবাহকে সমৃদ্ধ করেছে। এসব পাহাড়ের গড় উচ্চতা আনুমানিক ৮০০-৯০০ ফুট। এসব উঁচু পাহাড় থেকে অসংখ্য ঝর্ণা সরাসরি তৈন খালের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে শেষ আশ্রয় খুঁজেছে! যেমন- থাঙ্কুয়াইন, লাদমেরাগ, পালংখিয়াং, চাইম্প্রা, জাফরুং, ক্রাতং ও শামুক ঝর্ণা ইত্যাদি। এছাড়াও রয়েছে অসংখ্য ঝিরি।

তৈনখাল: উৎসের দিকে আছে বৈচিত্র্যময়তা

তৈনখালের একেবারে উজানে দিকে রয়েছে বেশ কয়েকটি গিরিখাত। বড় বড় বোল্ডার পাথর তৈনের পানিপ্রবাহে বেশ প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে। কয়েকটি গিরিখাত ও বোল্ডারের প্রতিবন্ধকতা শেষে আরও উজানে গেলে তৈনখালের মূল উৎসটা পাথর আর জঙ্গলের খাদে হারিয়ে যায়! দুরন্ত অভিযাত্রিক ছাড়া তৈনের উৎসমুখের পরিসীমা মাপা দুষ্কর!

তৈনখাল উৎসমুখ থেকে মাতামুহুরী নদীতে মিলনস্থল পর্যন্ত প্রায় ৫০ কিলোমিটার পাহাড়ি পথ পাড়ি দিয়েছে। যে পাহাড় থেকে তৈনখালের উৎপত্তি হয়েছে সেই পাহাড়ের পশ্চিম অংশ হতে সিন্দুখাল নামের আরেকটি খালের উৎপত্তি। সিন্দুখালটি মাতামুহুরী নদীর একটি উপনদী।

  • তৈনখালের গঠনপ্রণালীঃ

আমাদের দেশে প্রাকৃতিক সৃষ্ট নদী কিংবা খাল প্রণালীতে অসংখ্য পানি সিঞ্চনকারী (ট্রিবিউটারি) রয়েছে। তৈনখালেও অনেকগুলি ট্রিবিউটারি আছে। তবে উৎপত্তিস্থল থেকে মিলনস্থল পর্যন্ত প্রায় ৫০ কিলোমিটারের দীর্ঘ যাত্রাপথে তৈনখাল নিজে কখনই ঝর্ণা হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েনি! যেমনটি রেমাক্রি খাল ঝাপিয়ে পড়েছে সাঙ্গুর বুকে।

চঞ্চলা রূপসী তৈনখাল আলীকদম সদরে আলীর পাহাড়কে সাক্ষী রেখে নিজেকে নিরবে-নিভৃতে সমর্পন করেছে মাতামুহুরীর অতৃপ্ত বুকে।

তৈনখালের সমাপ্তিস্থল অনতিদূরে! মাতামুহুরীর বুকে যার সমাপ্তি

তৈনখাল উৎসমুখে পূর্ব দিক থেকে প্রায় ৫ কিলোমিটার পশ্চিমে বয়ে এসেছে। এরপর পাহাড়ের ফাঁক গলে দক্ষিণ থেকে উত্তর দিকে বাঁক নিয়ে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়েছে। দোছরী বাজারের কাছে এসে সোজা পশ্চিম দিকে বাঁক নিয়ে প্রকৃতির এই মনোমোহকর-নন্দিনী অক্লান্তভাবে ছুটে এসেছে খরস্রোতা মাতামুহুরীর দিকে। চলতি পথে প্রাণবন্ত করেছে আলীকদম উপজেলার বিস্তীর্ণ পাহাড়ি অঞ্চল। তার আছল বিছিয়ে গড়ে তুলেছে সবুজাভ বনভূমি! সৃজন করেছে অপার সৌন্দর্যের মহাকাব্যিক স্বর্গভূমি।

কিছু কিছু জায়গায় তৈন’র দুই তীর লম্বা ঘাসে বেষ্টিত অথবা ঘন বনে ছাওয়া। যা ভেদ করে ওপরের আকাশ দেখা ছাড়া পৃথিবীর আর কিছুর অস্তিত্ব টের পাওয়া যায় না। তৈনখাল একটু পর পর বাঁক নিয়ে সবুজের দেয়ালের দৃশ্যপটে পরিবর্তন ঘটায়। অকাস্মাৎ বেরিয়ে আসে অপরূপ সুন্দর দৃশ্য।

তৈনখালের বাঁকে বাঁকে দেখা যায় বাদামি রঙের উজ্জ্বল পাথুরে খাঁড়ি, পাথরের গায়ে নানা রঙের মস আর ফাঙাসজাতীয় উদ্ভিদের চাদর। ডানে-বামে দেখা যায় ঘন দুর্ভেদ্য জঙ্গল। কিছু জায়গায় তৈনখাল চলেছে দ্রুতবেগে, পিচ্ছিল পাথরের গা বেয়ে। বর্ষায় এর শক্তিশালী স্রোতকে বশে রেখে নৌকা চালানো খুবই কঠিন। শুষ্ক মৌসুমে কয়েকটি স্থানে তৈনখাল হঠাৎ বাঁক নিয়েছে। ফলে সেসব স্থানে নৌকা চালানো খুবই দুঃসহ কাজ। সম্প্রতি তৈনখাল ভ্রমণকালে আমাদের নৌকার চালক দুই কিশোরের প্রাণান্ত কসরত দেখে তাই মনে হলো।

  • তৈনখালের বৈচিত্র্যময়তাঃ

তৈনখালের মনোরম নৈসর্গিক সৌন্দর্য বেশী দেখা যায় দোছরী বাজারের পর উজানের দিকে। আলীর পাহাড়ের পাদদেশ থেকে উৎসমুখ পর্যন্ত তৈনখালের সর্পিল পথচলা যেন বৈচিত্র্যে ঐক্যতান। কখনো পূর্ব থেকে পশ্চিমে আবার উত্তর থেকে দক্ষিণে এটি বাঁক নিয়েছে। খালটির বুকের অনেকটা জায়গাজুড়ে পাথুরে আস্তরণ দেখা যায়।

তৈনখালজুড়ে রয়েছে পাথরের আস্তরণ

তৈনখাল বর্ষার পানিতে উম্মত্ত-তাণ্ডবলীলায় মেতে উঠলেও চৈত্র-বৈশাখে খেয়ালী অভিমানী হয়ে যায়। খেয়ালের বশে তার পুরো অবয়বজুড়ে দেখা যায় নানা বৈচিত্র্য। খালটির বুকে তখন ভেসে উঠে পাথরের স্তুপ। যা বর্ষায় তেমন দেখা যায় না। খালের কোথাও গভীর কুমে প্রচুর পানি জমা রাখে, কোথাও গোড়ালি পরিমাণ পানিতে নিজের বুকটা ভিজিয়ে রাখে!

উল্লেখ্য, ‘কুম’ এক ধরনের পানির আধার। কুমে প্রচুর মাছ পাওয়া যায়। বিভিন্ন খালে কিংবা নদীতে অসংখ্য ‘কুম’ রয়েছে। নদী কিংবা খালের আপার কোর্সের পরে ‘কুম’ সৃষ্টি হয়। তবে অব্যাহত বৃক্ষ নিধন, জুম চাষের কারণে পাহাড়ের মাটি ধুঁয়ে নদী-খালে চলে আসায় বর্তমানে ‘কুম’ হারিয়ে যাচ্ছে।

তৈনখালের পাড়ে নাম না জানা একটি গাছ। গাছটির ফুলের সুবাসে আশেপাশের এলাকা গন্ধে মৌ মৌ করছে!

তৈনখালের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আরেকটি বর্ণনা দেখা যায় ক্যাপ্টেন টি. এইচ. লেউইন এর বইয়ে এভাবে-

`… from some gnarled old forest giant here and there the long curving creepers threw across the stream a bridge of nature’s own making. Sometimes we came upon a recess in the bank of verdure which rose on either hand; and there the tinkling of a cascade would be beard behind the veil, its entry into the stream being marked by a great grey heap of round- ed rocks and boulders, toppled and tossed about in a way that showed with what a sweep the water came down in the rains.’ (Reference: ‘The Hill Tracts of Chittagong and the Dwellers Therein’ Page-3)

(অনুবাদঃ এপারের নুয়ে পড়া গাছের কিছু ঝুল আবার মিলেছিল ওপারের ঝুলের সাথে, যেন প্রকৃতির নিজের তৈরি করা সেতু। কখনো যখন বিশ্রামের জন্য থেমেছিলাম, তা সে যে পাড়েই হোক না কেন, সবুজের আড়াল থেকে ভেসে আসছিল অনবরত কোনো ঝর্ণার শব্দ। এসব ছোট ছোট ঝর্ণা যেখানে  স্রোত এসে মেশে, সেখানে দেখা যায় বড় বড় গোলাকার ধূসর পাথর। এসব পাথরের বিন্যাস যেন বুঝিয়ে দিচ্ছিল কীভাবে বৃষ্টির জল ওপর থেকে ঝরে পড়ে। সবেগে ছুটে চলে আর ধুয়ে মুছে নিয়ে যায়।

তথ্যসূত্র: ‘The Hill Tracts of Chittagong and The Dwellers Therein’ Page-3)
  • তৈনখালের আকর্ষণঃ

তৈনখাল আলীকদম উপজেলার নিসর্গ-প্রকৃতিতে যোগ করেছে ভিন্নমাত্রা। এ উপজেলার অসংখ্য ঝর্ণা, ঝলপ্রপাতকে নিজ বুকে ধারণ করেছে তৈনখাল । এসব ঝর্ণার নামগুলি পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে। আলীকদম সদর থেকে দোছরী বাজার পর্যন্ত তৈনখালের সৌন্দর্য এবং দোছরী বাজার থেকে উৎসমুখ পর্যন্ত প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের ভিন্নতা ও নান্দনিকতা আছে।

তৈনখালে হেঁটে যাচ্ছে পর্যটকের দল

দোছরী বাজারের পর থেকে উৎসমুখ পর্যন্ত কিছুদূর পরপর বোল্ডার পাথর রয়েছে। উৎসমুখের কাছের দিকে যতই অগ্রসর হওয়া যায় ততই পাথরের স্তুপ আর নানানরূপে গড়া বোল্ডারের গোলক ধাঁধা দেখা যায়! তৈনখালের বুকে জলসিঞ্চনকারী ঝর্ণাসমুহ দেখতে সারাদেশ থেকে বছরের বিভিন্ন মৌসুমে হাজারো পর্যটক আগমণ করেন। একটি খালের মধ্যে সচরাচর এতো ঝর্ণা দেখা যায় না, যা তৈনখালের দু’পাশজুড়ে আছে।

  • তৈনখালে নৌ যোগাযোগঃ

তৈনখালের গঠনপ্রণালীর কারণে আলীকদম সদর থেকে দোছরী বাজার পর্যন্ত বর্ষায় কিংবা গ্রীষ্মে নৌকা চলাচল করতে পারে। দোছরী বাজারের উজান থেকে খালের ওপর বোল্ডার পাথর থাকায় নৌকা চলাচল করতে পারে না। আষাঢ় মাস থেকে আশ্বিন পর্যন্ত খালের বুকে পানির প্রবাহ থাকে মোটাদাগে। তাই এ সময় নৌপরিবহন সাবলীল। অন্যসময় খালটির বিভিন্ন স্থানে বাধ দিয়ে নৌকা ও ভেলা বোঝাই করে চলাচল করতে হয়। যা দুরহ ও কষ্টসাধ্য।

  • তৈন’র পানি সিঞ্চনকারী ঝিরিসমুহ:

তৈনখালের পানির প্রবাহে যুক্ত হওয়া পানির উৎসকে দু’ভাগে ভাগ করা যায়। ১. ঝর্ণাসমুহ, ২. ঝিরিসমুহ। এই ঝিরি-ঝর্ণাগুলোকে আবার দু’ভাগে ভাগ করা যায়। ১. চিম্বুক রেঞ্জের পর্বতসারি থেকে সৃষ্ট ঝিরি-ঝর্ণা। ২. চিম্বুক পর্বতসারির পশ্চিমের সাবসিডিয়ারি পাহাড়সারি থেকে উৎপন্ন ঝিরি-ঝর্ণা।

এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য ঝিরিগুলো হলোঃ

হরিণ ঝিরি, ছোট ডলু ঝিরি, বড় ডলুঝিরি, ফুটের ঝিরি, রেইস্যা ঝিরি, সেইং ঝিরি, দোছরী ঝিরি, উতাল ঝিরি, কাঁকড়া ঝিরি, কাতল ঝিরি, ছোট চাইম্প্রা ঝিরি, বড় চাইম্প্রা ঝিরি, ভাল্লুক ঝিরি, বাঘের ঝিরি, উইপাং ঝিরি, ছোট আম ঝিরি, বড় আম ঝিরি, পুংকাং ঝিরি, লিচু ঝিরি ও পাইয়্যা ঝিরি।

এসব ঝিরিগুলো অপেক্ষাকৃত বড় হওয়ায় নামকরণ হয়েছে। এছাড়াও নাম না জানা অসংখ্য ঝিরি আছে তৈনখালের পুরো অবয়বজুড়ে।

  • তৈনখালে’র জীববৈচিত্র্য:

প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আধার তৈনখালের জীববৈচিত্র্য দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রথম জেলা প্রশাসক ক্যাপ্টেন টি.এইচ. লেউইন (১৮৩৯-১৯১৬)। তাঁর লেখা বইয়ে তিনি তৈনখালের জীববৈচিত্র্যের বর্ণনা দেন এভাবে-

‘Scarlet dragon- flies and butterflies of purple, gold, and azure, flitted like jewels across our path; while silvery fish, streaked with dark-blue bands, flew up the stream before us, like flashes of light, as we poled along.’ (Page: 3-4)

(অনুবাদঃ আমাদের পথের ধারে এদিকসেদিক উড়ছিল লাল চোখওয়ালা ডাঁশ মাছি আর বেগুনি, সোনালি, নীল প্রজাপতির দল; মনে হচ্ছিল যেন পথে ছড়ানো রঙিন মুক্তো। আর নদীতে আমাদের পার করে উজান চলছিল নীল দাগওয়ালা রুপোলি মাছের ঝাঁক।)

তথ্যসুত্র: ”The Hill Tracts of Chittagong and The Dwellers Therein’ Page-3)

তৈনখালে পাহাড়ি নারীর মাছ শিকার

তৈনখালে প্রচুর মাছ পাওয়া যায়। তৈনখালের পতনস্থল থেকে শুরু করে উজানের দিকে কিছুদূর পর পর কুম রয়েছে। এসব কুমে বোয়াল, রাশো, পুঁটি, রুই, বাইলা, বাইম, চিংড়ি ইত্যাদি মাছ পাওয়া যায়। আরো অনেক জাতের নাম না জানা মাছের দেখা মেলে। মি. লেউইন এই খালে নীল দাগওয়ালা রুপোলী মাছের অস্তিত্ব দেখেছিলেন আরও দুইশ’ বছর আগে! এই খালে শামুক, কাঁকড়া ও নানান প্রজাতির ব্যাঙ আছে। কয়েকটি স্থানের নাম ‘মাছকুম’ হিসেবে পরিচিত। এসব কুমে প্রচুর মাছ পাওয়া যায়। সম্প্রতি দোছরী বাজারে তৈনখালের সুস্বাদু রাশো মাছের স্বাদ নিয়েছি।

তৈনখালের উজানের দিকে বানরের অস্তিত্ব আছে। রয়েছে হরিণ, বন মোগর, বুলবুলি, টিয়া, ময়না, রাতচোরা, মাছরাঙ্গা, শালিক, ডাহুক, ধনেশ-সহ নানান প্রজাতির পাখি। বিশেষ করে গাঢ় নীলবর্ণের প্রজাপতি ও গঙ্গাফড়িং নদীর দু’ধারে উড়াউড়ি করতে দেখা যায়। যা বড়ই মনোহর!

  • পরিবেশ বিপর্যয় ও অর্থনীতিঃ

সম্প্রতি তৈনখাল ভ্রমণে দেখা গেছে তৈনের পাড়ে পাড়ে জুম চাষের জন্য নিদারুণ বৃক্ষ নিধন! জুম চাষ সেখানকার অধিবাসী ত্রিপুরা, মুরুং ও তঞ্চঙ্গ্যার জীবিকা নির্বাহের প্রধান অবলম্বন। অনাধিকাল ধরে জুম চলে আসছে। তবে তৈনপাড়ে জুম চাষের কারণে পাহাড় ক্ষয়ে তৈনের বুকে পাহাড় ধ্বস ও পলি জমছে। তৈনখালে রয়েছে প্রচুর চর জমি। আলীকদম সদরের দিকে তৈনখাল পতনের স্থলে আলীর সুড়ঙ্গ-মংসুইপ্রু পাড়া এলাকায় তৈনের বুকে তামাক চাষ হচ্ছে। বিশেষ করে আলীকদম সদর হতে দোছরী পর্যন্ত তামাক চাষের বিস্তৃতি লক্ষণীয়।

তৈনখালের পাড়ে জুম চাষ: বিপন্ন পরিবেশ-প্রকৃতি

ফলশ্রুতিতে পরিবেশগত ঝুঁকিতে তৈনখালের পরিবেশ-প্রকৃতি ও তীরবর্তী বাসিন্দারা। তৈনখাল দিয়ে বর্ষা মৌসুমে প্রচুর চোরাই কাঠ পাচার করে থাকে বনদস্যু-কাঠ ব্যবসায়ীরা। তৈনখাল যেখান থেকে উৎপন্ন সেখানে মাতামুহুরী রিজার্ভের বিস্তীর্ণ বন।

পরিতাপের বিষয়, বন আর আগের মতো নেই। অব্যাহত বৃক্ষ নিধন ও জুম চাষের কারণে পাহাড়ের গায়ে গায়ে শ্মশানের ছাইয়ের ধুসরতা পরিলক্ষিত। সবুজাভ অরণ্যের বৃক্ষ নিধন ও জুম চাষ যেন এক বিরাট চপেটাঘাত। জুম চাষ ও বৃক্ষ নিধনের কারণে তৈনের উৎস মুখ থেকে নিচের ঝিরি-ঝর্ণাগুলো হুমকীর মুখে। কারণ বড় বড় গাছের বনগুলো ঝিরি-ঝর্ণা-খালের পানির প্রাকৃতিক উৎস। বিন্দু বিন্দু পানিতে তৈনের বুক সিঞ্চন যেমন হয়েছে তেমনি তৈনখাল জলদান করে মাতামুহুরীর প্রবাহকে দিয়েছে গতিময়তা।

আসুন! সকলে মিলে বন রক্ষা করি। প্রকৃতির রূপসী কন্যা তৈনখালকে বাঁচিয়ে রাখি।

তারিখ: ১৯ মার্চ ২০২৩ খ্রি:

লেখক: মমতাজ উদ্দিন আহমদ
সভাপতি, আলীকদম প্রেসক্লাব, বান্দরবান পার্বত্য জেলা।
Email: momtaj.news@gamil.com,
মোবইল: ১৫৫৬৫৬০

মমতাজ উদ্দিন আহমদ