প্রকৃতিতে কিছু নিদর্শন শুধু মুগ্ধতা ছড়ায়। এসব খালি চোখে দেখা যায় শুধু। রহস্যের কুলকিনারা করা যায় না! এমনই একটি অতিপ্রাকৃতিক নিদর্শনের খোঁজ মিলেছে আলীকদম উপজেলার চৈক্ষ্যং ইউনিয়নের পানির ঝিরির উজানে। এ ঝিরির একটি শাখা ঝিরির নাম ‘বাদুড় ঝিরি’। সেই বাদুড় ঝিরির নামানুসারে স্থানীয়রা সুড়ঙ্গটির নাম দিয়েছেন ‘বাদুড় ঝিরি সুড়ঙ্গ’।
সম্প্রতি এ সুড়ঙ্গ পরিদর্শনে যান চৈক্ষ্যং ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জয়নাল আবেদীন, আওয়ামী লীগ নেতা সিরাজুল ইসলাম ও আলীকদম প্রেসক্লাব সভাপতি মমতাজ উদ্দিন আহমদের নেতৃত্বে একটি বহর।
পাহাড়ি জেলা বান্দরবানের আলীকদম উপজেলার সবুজাভ প্রকৃতিতে লুকিয়ে থাকা অসংখ্য ঝর্ণা, জলপ্রপাত, রহস্যময় গুহা, গভীর কুম (জলাশয়) ও উঁচু পর্বত ইতোমধ্যে পর্যটকদের নজরে এসেছে।
‘বাদুর ঝিরি সুড়ঙ্গ’ এসব প্রাকৃতিক নিদর্শনের মধ্যে সর্বশেষ সংযোজন। এটি পর্যটকদের জন্য নতুন আকর্ষণ হিসেবে ইতোমধ্যে পরিচিত লাভ করতে শুরু করেছে।
২০২২ সালের ১১ জানুয়ায়ী প্রথমবারের মতো স্থানীয় সাংবাদিকদের একটি দল বাদুড় ঝিরি সুড়ঙ্গের সন্ধানে যান। সেবার সুড়ঙ্গটির সচিত্র প্রতিবেদন তাঁরা তুলে ধরেন।
ট্যুর প্লান যেভাবেঃ
সম্প্রতি ডাঃ সিরাজুল ইসলাম ও ইউপি চেয়ারম্যান জয়নাল আবেদীনের আহ্বানে দ্বিতীয় বারের মতো বাদুড় ঝিরি সুড়ঙ্গ পরিদর্শনের যাওয়ার পরিকল্পনা করা হয়। আলীকদম উপজেলা সদর থেকে আমরা চিনারী বাজারে রওয়ান হই। পূর্ব হতে সেখানে ডাঃ সিরাজ-জয়নাল চেয়ারম্যানের টীম অবস্থান করছিলেন।
এরপর আমাদের যাত্রা শুরু হয় চিনারী বাজার-রূপসী পাড়া সড়ক ধরে। সকলের বাহন বাইক। সকলেই আনন্দিত। কারণ আমাদের টীমের মধ্যে আমরা দু’তিন ছাড়া আগে কেউ ‘বাদুড় ঝিরি সুড়ঙ্গ’ দেখেন নি। তাই সকলের মধ্যে অজানা-অদেখা একটি প্রাকৃতিক নিদর্শন প্রথমবার দেখবেন তাই ছিল আরাধ্য।
আমরা পৌঁছে গেলাম চিনরী বাজার-রূপসী পাড়া সড়কের পাশে সোনা চন্দ্র ত্রিপুরা পাড়ার নিকটবর্তী সেগুন বাগানে। সেখানে আমাদের বাইক রাখা হলো।
এবার সকলেই পায়ে হেঁটে পানির ঝিরি ধরে উজানের দিকে হাঁটা শুরু করলাম। পানির ঝিরির বুকে অল্পস্বল্প প্রবাহমান পানি প্রবাহিত আছে।
পানির ঝিরির একটি শাখা ঝিরি হলো বাদুড় ঝিরি। এবার আমরা হাঁটছি আমরা হাঁটছি বাদুড় ঝিরির উজানে। কাঁদা পানি, ঝোঁপ-ঝাড় মাড়িয়ে চলছি তো চলছিই।
চলতি পথে কৃষিকাজে ব্যস্তসমস্ত কয়েকজন ত্রিপুরা ও মার্মা নৃগোষ্ঠীর লোকজন জানতে চাইলেন আমাদের গন্তব্য কোথায়! জানালাম- যাচ্ছি বাদুড় ঝিরি সুড়ঙ্গ দেখতে!
আমরা বাদুড় ঝিরির উজানে আনুামিক ৩০ মিনিট হাঁটার পর এ ঝিরির ডানপাশে আরেকটি ঝিরি দেখতে পেলাম।
এ ঝিরির নাম ‘সুরম ঝিরি’। তার মানে এই ঝিরির উজানেই রয়েছে সুড়ঙ্গ!
আমরা সুরম ঝিরি বেয়ে আরো ৫ মিনিটের মতো হাঁটলাম। অবশেষে পৌঁছে গেলাম কাঙ্খিত ‘বাদুড় ঝিরি সুড়ঙ্গে’।
স্থানীয় ফেরদৌস আহমদ জানান, আগে বাদুর ঝিরির সুড়ঙ্গের মুখ ছোট ছিল। বর্তমানে এর মুখটা অনেক বড়ো! তাতে অনায়াসে হেঁটে পার হওয়া যায়!
আমরা সকলে আভিভুত হলাম প্রাকৃতিক এ নিদর্শণ দেখে!
যতদূর জানা গেলো স্থানীয় কিছু কাঠুরিয়া ছাড়া কেউ আনুষ্ঠানিকভাবে এ সুড়ঙ্গ দেখতে সেখানে যায়নি।
আমরাই দ্বিতীয় অভিযাত্রিক; যারা কিনা আনুষ্ঠানিক দর্শনার্থী ‘বাদুড় ঝিরি সুড়ঙ্গের!’
সুড়ঙ্গটি দেখতে ত্রিভূজ আকৃতির একটি গেইটের মতো। যেন প্রকৃতির চাদরে মোড়ানো অতি চমৎকারিত্বে ভরা একটি গেইট। যে কোন দর্শনার্থীকে যেন এ গেইটের রক্ষক স্বাগত জানাচ্ছেন!
সুড়ঙ্গের দু’পাশের গায়ের মাটি পাথুরে। সুড়ঙ্গের ওপরে সুউচ্চ পাহাড়। আমরা সুড়ঙ্গ মুখ পার হয়ে গেলাম।
সেখানে দেখা গেলো ত্রিভূজ আকৃতির একটি স্থান। তিনপাশেই খাড়া সুউচ্চ পাহাড়। উপরের দিকে রোদের ঝিলিমিলি।
তখন মধ্যগগণের সূর্যের আলোকরশ্মি পাহাড়ের দেয়াল আর বুনোপ্রকৃতি ভেদ করে ত্রিভূজচক্রের মাটিতে পড়ে চিকচিক করছিল।
সুড়ঙ্গের আশে-পাশে আলো-আঁধারী। অদ্ভুত এক বুনো পরিবেশ! সুড়ঙ্গের নীচে স্যাঁতস্যাঁতে ভেজা।
সুড়ঙ্গের নাম স্থানীয়রা ‘বাদুড় ঝিরি সুড়ঙ্গ’ নামকরণ করলেও সেখানে বাদুড় প্রজাতির কোন উড়াউড়ি কিংবা প্রমোদ নীড়ের দেখা মিলল না!
একসময় আলীকদম উপজেলা সদরের ঐতিহাসিক আলীর সুড়ঙ্গে বাদুড়ের দেখা মিলতো। এখন তেমন বাদুড়ের দেখা মিলে না।
যাত্রার শুরুতে মনে করেছিলাম বাদুড় ঝিরি সুড়ঙ্গে অনেক বাদুড়ের দেখা পাবো! তাই সতর্কও ছিলাম কিছুটা! যাতে বাড়ুদের পাখার ঝাপটানি খেতে না হয়।
বাদুড় ঝিরি সুড়ঙ্গ দেখার পর এবং আমাদের গাইড এর কথা শুনে চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙের একটি মনে পড়ে গেলো। তিনি বলেছেন- ‘নদী-নাব্য জলাভূমির এ দেশে প্রাকৃতিক নিদর্শনগুলো খুব সহজেই হারিয়ে যেতে পারে।’
আমরা এর বাস্তব উদাহরণ হিসেবে দেখতে পাই ‘আলীর সুড়ঙ্গ’ এর বেলায়। বিগত দুই দশক কিংবা একযুগ আগেও আমরা যেভাবে আলীর সুড়ঙ্গের অস্তিত্ব দেখেছিলাম এখন সে পরিবেশ নেই।
সুড়ঙ্গের কয়েটি গুহামুখ মাটি চাপা পড়ে গেছে। যা বর্তমানে দর্শনার্থীরা বুঝতেও পারবেনা এক দশক আগে এর কী রূপ ছিলো।
সুড়ঙ্গ দেখা শেষ!
মনে একটি অকৃত্রিম ভালো লাগার আবেশ নিয়ে আমরা ফিরে আসলাম।
বাদুড় ঝিরি সুড়ঙ্গ হতে পারে পর্যটকদের জন্য নতুন আকর্ষণ।
বাদুড় ঝিরি সুড়ঙ্গকে ঘিরে পরিকল্পনাঃ
নতুন এ পর্যটন স্পটকে ঘিরে স্থানীয় একটি উদ্যোক্তা গ্রুপ ‘নন্দন কানন’ নামে পর্যটন তৈরীর উদ্যোগ নিয়েছেন। ইতোমধ্যে সুড়ঙ্গ এলাকার পাহাড়টি স্থানীয় এক ব্যক্তির কাছ থেকে উপযুক্ত মূল্যে পাহাড়টি ক্রয় করা হয়েছে। ঈদের পর থেকে সেখানে পর্যটন বিকাশের জন্য পাহাড়ি ডিজাইনে স্থাপনা নির্মাণ করা হবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
কিভাবে যাবেনঃ ঢাকা থেকে সরাসরি আলীকদম উপজেলায় হানিফ এবং এস.আলম পরিবহনের বাস চলাচল করে। আলীকদম-ফাঁসিয়াখালী সড়কের চিনারী বাজারে নামতে হবে। চিনারী বাজার-রূপসী পাড়া সড়কের পাশে সোনা চন্দ্র পাড়া পার হয়ে যেতে হবে পানির ঝিরি। পানির ঝিরির একটি শাখার ঝিরির নাম ‘বাদুড় ঝিরি’। এ ঝিরির উজানে আনুমানিক ৩০-৪০ মিনিট উজানে গিয়ে ডান পাশের ঝিরির নাম সুরম ঝিরি। সুরম ঝিরির উজানে আনুমানিক ৫ মিনিট হাঁটলেও পেয়ে যাবেন ‘বাদুড় ঝিরি সুড়ঙ্গ।’
গাইড পাবেন কোথায়ঃ আবাসিক রাস্তার মাথায় ডাঃ সিরাজ কিংবা ইয়াছিনের সাহায্য নিয়ে গাইড নিতে পারবেন।
নির্দেশনাঃ ভোটার আইডি কার্ডের ফটোকপি রাখবেন। শুকনো খাবার, খেজুর, স্যালাইন ও প্রয়োজনীয় ওষুধ রাখুন।
বিশেষ অনুরোধঃ অনুগ্রহ করে খাবারের অপচনশীল মোড়কগুলো সঙ্গে নেওয়া ব্যাগে করে নিয়ে আসুন। সম্ভব হলে অন্যদের ফেলে দেওয়া মোড়কগুলোও কুড়িয়ে পরিচ্ছন্ন করুন। মনে রাখবেন পরিবেশ-প্রাণ-প্রকৃতি রক্ষার দায়িত্ব সকলের।
সতর্কতা: অপচনশীল দ্রব্য যেমন চিপসের প্যাকেট, সিগারেটের ফিল্টার, পানির বোতলসহ অন্যান্য আবর্জনা ঝর্ণা এলাকায় ফেলবেন না। বর্ষা মৌসুমে ঝর্ণার পথে জোঁক থাকতে পারে, তাই সতর্ক থাকুন।
======================================
লেখক:
মমতাজ উদ্দিন আহমদ,
সভাপতি,
আলীকদম প্রেসক্লাব
বান্দরবান পার্বত্য জেলা।
মোবাইল: 0155656126 / 01645950296
email: momtaj.news@gmail.com
======================================
আপনার মতামত লিখুন :