॥মমতাজ উদ্দিন আহমদ॥
ঐতিহাসিক দর্শনের জনক সর্বকালের স্মরণীয় প্রতিভা আল্লামা ইবনে খালদুনের লেখা অমর সৃষ্টি ‘আল মুকাদ্দিমা’য় যেসব বিষয়বৈচিত্র্য রয়েছে তা যে কাউকে মুগ্ধ করবে। সম্প্রতি তাঁর লেখা এ গ্রন্থটি অধ্যায়ন করে যাচ্ছি। আল মুকাদ্দিমায় মানবেতিহাসের জটিল থেকে জটিলতর প্রসঙ্গ এবং মানবচরিত্রের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিষয় তিনি যেভাবে ফুটিয়ে তুলেছে তা তুলনারহিত।
ইবনে খালদুনের জন্ম হয় ২৭ মে ১৩৩২ খ্রিস্টাব্দে তিউনিয়াসের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে। জীবদ্দশায় তার অতুলনীয় পাণ্ডিত্য সর্বস্তরে ছড়িয়ে পড়ে। মুত্যকাল পর্যন্ত রাজকীয় পদমর্যদায় ভূষিত ছিলেন তিনি। জীবনের অনেক ঘাত-প্রতিঘাত এবং শত্রুর প্রবল মোকাবেলা শেষে মিশরের প্রধান বিচারপতি থাকাবস্থায় ১৭ মার্চ ১৪০৬ খ্রিস্টাব্দে পৃথিবীর বিরল মণীষার অধিকারী সংগ্রামী এ কর্মী পুরুষ লোকান্তরিত হন।
জীবদ্দশায় খ্রিষ্ট্রীয় চুতর্থদশ শতাব্দির মধ্যভাগে প্লেগ মহামারি ছোবলে বিলীয়মান শিক্ষাদীক্ষা থেকে ইবনে খালদুন প্রয়োজনীয় উপকরণ তুলে এনে জীবনের সারবত্তাকে কাজে লাগিয়েছিলেন। সুতরাং তার লিখিত গ্রন্থটি অত্যন্ত সুখপাঠ্য। তৎকালীন জনগোষ্ঠীসমুহের বিবরণ ও সমকালীন পৃথিবীকে জানার অনবদ্য রচনা আল মুকাদ্দিমা।
আল মুকাদ্দিমার প্রথম খন্ডে তিনি মানব সভ্যতায় খাদ্যের প্রাচুর্য ও ক্ষুধাজনিত বিভিন্ন অবস্থা এবং মানবদেহ ও চরিত্রের ওপর খাদ্যের প্রভাব সম্পর্কে একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করেছেন। তার চুম্বুকাংশে তুলে ধরার চেষ্টা করছি।
আল্লামা ইবনে খালদুনের মতে, ‘অতিরিক্ত আহার্য ও অতিরিক্ত পচনশীল মিশ্রিত খাদ্যরস দেহের মধ্যে অতিরিক্ত মেদের সৃষ্টি করে। এর ফলে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ অসমঞ্জসরূপে বেড়ে উঠে এবং এর প্রতিক্রিয়ায় মেদবাহুল্যতার ফলে বিবর্ণতা ও গঠনের বিকৃতি দেখা দেয়। অতিরিক্ত খাদ্যরস থেকে উত্থিত দূষিত বায়ু মেধা ও মননের উপর আচ্ছন্নতার সৃষ্টি করে এবং এরই ফলশ্রুতি হিসাবে নির্বুদ্ধিতা, উদাসীনতা ও সমভাবাপন্নতা থেকে দূরে সরে যাওয়ার স্বভাব জাগ্রত হয়।’
ইবনে খালদুন মানুষের খাদ্যাভ্যাসের সাথে প্রান্তর ও শুষ্ক এলাকার প্রাণীদের নিয়ে একটি তুলনা করেছেন। তার মতে পাহাড়ি, সমুদ্র তীরবর্তী ও শ্যামল চারণভূমির পশু এবং শুষ্ক এলাকার প্রাণীদের মধ্যে চামড়ার সৌন্দর্য, গঠন ও অবয়বের সৌকর্য, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সৌসাদৃশ্য এবং অনুভূতির তীব্রতার দিক থেকে প্রচুর পার্থক্য রয়েছে। এর কারণ পাহাড়ী এলাকার প্রাচুর্য তাদের শরীরে অতিরিক্ত মেদ আর ক্ষুধা প্রান্তরের প্রাণীগুলোর সুঠাম দেহ ও গঠন-সৌকর্য আলাদা।
খাদ্যাভ্যাস নিয়ে মানবগোষ্ঠীর মধ্যেও একই দৃষ্টান্তের ইঙ্গিত দিয়েছে ইবনে খালদুন। পৃথিবীর যেসব অঞ্চলে শস্য, দুগ্ধ, মসল্লাদি ও ফলমূলের আধিক্যজনিত কারণে সেসব এলাকার লোকজন খাদ্য প্রাচুর্যে থাকেন তাদের অধিকাংশ মেধাশক্তির দুর্বলতা ও দৈহিক গঠনের স্থূলতায় থাকে। উদাহরণ হিসেবে তিনি প্রাচুর্যের মধ্যে থাকা এবং জীবন-যাপনে অসচ্ছলতার অধিকারী কয়েকটি গোত্রের নাম উল্লেখ করেছে তার লেখা গ্রন্থে। জীবন-যাপনে অসচ্ছলতায় থাকা গোষ্ঠীসমুহের মধ্যে তিনি বুদ্ধিমত্তার প্রাচুর্য ও দৈহিক গঠনের সৌকর্য অধিকতর বলে অভিমত ব্যক্ত করেন।
তার মতে, প্রাচুর্যে থাকা পল্লীবাসীদের দৈহিক গঠন প্রান্তরবাসী কঠোর জীবন-যাপনকারীদের দেহের তুলনায় ক্ষীণ হয়ে থাকে। এভাবে অনাহারে অভ্যন্ত প্রান্তরবাসীদের দেহে গুরু বা লঘু কোন প্রকার অতিরিক্ত মেদ পাওয়া যায় না।
তিনি লিখেছেন, প্রাচুর্যের ফলে দেহ ও তার বিভিন্ন অবস্থার উপর যে প্রভাব বিস্তারিত হয়, ধর্ম ও উপাসনার ক্ষেত্রেও তার প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। কঠোর জীবন-যাপনের অভ্যন্ত প্রান্তরবাসী কিংবা নগরবাসী, যারা অনাহার ও উপাদেয় ভোজ্যাদি গ্রহণ না করায় অভ্যস্ত, তারাই সমৃদ্ধি ও প্রাচুর্য বিলাসীদের অপেক্ষা ধর্মীয় ব্যাপারে উত্তর ও উপসনাদিতে অধিকতর আগ্রহী হয়ে থাকে।
বরং পল্লী ও নগরবাসীদের মধ্যে ধার্মিক লোকের সংখ্যা খুবই অল্প। কারণ অতিরিক্ত মাংস, মসল্লা ও উত্তম গম আহারের ফলে তাদের মধ্যে কাঠিন্য ও উদাসীনতা দেখা দেয়। এজন্যই আহার্যের অনটনে অভ্যন্ত প্রান্তরবাসীদের মধ্যেই বিশিষ্ট উপাসক ও সাধকের সংখ্যা বেশি। অনুরুপভাবে একই নগরীর অধিবাসীদের মধ্যেও সমৃদ্ধি ও প্রাচুর্যের তারতম্যের ফলে অবস্থার ইতরবিশেষ ঘটে থাকে।
তার সমসাময়িক বিভিন্ন রাজ্য এবং গোষ্ঠীসমুহের ওপর সুগভীর অনুসন্ধিৎসা লক্ষ্য করা যায় তার রচিত ঐতিহাসিক আল মুকাদ্দিমা গ্রন্থের পরতে পরতে। তিনি তার গ্রন্থের পাঠকদের বারবার নানান উদাহরণ দিয়ে বুঝাতে চেয়েছেন মানুষের খাদ্যাভ্যাস কিভাবে মানুষকে তার কর্মে-উদ্দীপনায় নানানভাবে নিয়ন্ত্রণ করে।
তিনি বলেছেন, প্রান্তর, নগর ও পল্লীর প্রাচুর্য বিলাসী ও সমৃদ্ধিতে মগ্ন লোকেরা যখন দুর্ভিক্ষের সম্মুখীন হয়, ক্ষুধার জ্বালায় অন্যলোক অপেক্ষা অতিদ্রুত আক্রান্ত ও বিপন্ন হয়ে পড়েন। তার মতে, প্রাচুর্যে মগ্ন ও মসল্লাদি ঘৃতে অভ্যস্ত ব্যক্তিদের পাকস্থলী তার স্বাভাবিক পাচকরস অপেক্ষা অধির রসের অধিকারী হয় এমন কি অনেক সময় তা সীমা ছাড়িয়ে যায়।
অতঃপর যখন খাদ্যের অভাবে তার অভ্যাসের পরিবর্তন ঘটে এবং মসল্লাদিও অভ্যস্ত আহার্যের অনটন দেখা দেয়, তখন অতিদ্রুত তাতে শুষ্কতা ও সংকোচন এসে পড়ে। বস্তুত পাকস্থলী অতিশয় দুবর্ল একটি অঙ্গ। এর ফলে তা রোগাক্রান্ত হয়ে পড়ে এবং অতিদ্রুত তার সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির মৃত্যু ঘটায়। সুতরাং দুর্ভিক্ষে মৃত্যুবরণকারীদের মৃত্যু তাদের অতীতের তৃপ্তিদায়ক অভ্যাসেরই ফল, নবাগত ক্ষুধার প্রতিক্রিয়া নয়।
যারা মসল্লাদি ও মাখনের পরিবর্তে দুগ্ধ পানে অভ্যস্ত, তাদের পাকস্থলীর জারকরস বৃদ্ধি না পেয়ে স্বাভাবিক অবস্থাতেই বিরাজ করে। তা স্বাভাবিক যে কোন খাদ্য গ্রহণ করতে পারে। সুতরাং খাদ্যের পরিবর্তনে তাদের পাকস্থলীতে শুষ্কতা বা অসহিষ্ণুতা দেখা দেয় না। এজন্য তারা প্রাচুর্যবিলাসী ও খাদ্যে অধিক মসল্লা গ্রহণকারীদের অপেক্ষা খুব কম বিপন্ন হয়।
মানুষের জৈবিক শক্তি যখন কোন বস্তুকে প্রিয় হিসাবে গ্রহণ করে, তখন তাই তার স্বভাব ও প্রকৃতির অন্তর্গত হয়ে পড়ে। বস্তুত মানব প্রকৃতি একান্তই বহুরূপী। সুতরাং সে যখন ক্রমান্বয়ে সাধনার দ্বারা অনাহারে অভ্যস্থ হয়ে উঠে তখন তাই তার অভ্যাস ও প্রকৃতি হয়ে দাঁড়ায়।
চিকিৎসকরা ধারণা পোষণ করেন যে, ক্ষুধা মৃত্যুর কারণ ঘটায়, তা একমাত্র হঠাৎ জৈবিক শক্তির উপর অনাহার চাপিয়ে দিলে কিংবা আহার্য সম্পূর্ণ বন্ধ করে দিলে সম্ভব হয়। তখনই পাকস্থলী স্বাভাবিক কার্যকারিতা হারিয়ে রোগাক্রান্ত হয়ে পড়ে এবং মৃত্যুকে ডেকে আনে। কিন্তু যদি উক্ত ব্যাপারটি ধীরে ধীরে সাধনার দ্বারা অল্প অল্প করে খাদ্য কমিয়ে করা হয়, যেমন সৃফি সাধকরা করে থাকেন; তা হলে আর মৃত্যুর ভয় থাকে না। এ পর্যায়ক্রমিক অভ্যাসটি খুবই প্রয়োজনীয়, এমন কি এ প্রকার সাধনা থেকে ফিরতে হলেও এটা করতে হবে। তা না করে যদি হঠাৎ পূর্বের আহারে ফিরে আসে, তা হলেও মৃত্যুর ভয় থাকে। এজন্য পূর্বের আহারে ফিরতে হলেও সাধনার মতই পর্যায়ক্রমে ফেরা দরকার।
ইবনে খালদুন তার সময়কালের কয়েকটি ঘটনার উল্লেখ করেন এভাবে- ‘আমরা এমন ব্যক্তিকেও দেখেছি, যিনি একাদিক্রমে চল্লিশ দিন ও তদপেক্ষা বেশিকাল অনাহারে থেকেছেন। আমাদের উস্তাদগণ সুলতান আবুল হাসানের দরবারে উপস্থিত ছিলেন। সেখানে ‘আলখাজরা’ (আলজেসিরাস) দ্বীপ ও ‘রান্দা’ থেকে আগত দুটি মেয়েলোককে হাজির করা হয়, যারা দুই বছর ধরে সম্পূর্ণ আহার ত্যাগ করে বেঁচে আছে। তাদের এ বিষয়টি প্রচারিত হলে তাদেরকে পরীক্ষা করা হয় এবং উক্ত বিষয়টি সত্য বলে প্রমাণিত হয়। তারা এভাবে মৃত্যু পর্যন্ত জীবন-যাপন করে গেছে।’
‘আমাদের সমকালীন অনেককে একমাত্র ছাগ দুগ্ধের উপর নির্ভর করতে দেখেছি। তারা দিনের কোন এক সময়ে অথবা ইফতারের সময় তা দোহন করে পান করতেন এবং এতেই তাদের আহার্যের কাজ চলত। তারা এভাবে পনের বছর পর্যন্ত জীবন কাটিয়েছেন এবং অনেকে আরও বেশি কাল। এটা অস্বীকার করবার উপায় নেই।’
তিনি বলেছেন, অনাহার অতিরিক্ত আহার অপেক্ষা সর্বদিক থেকেই দেহের জন্য অধিকতর উপযোগী; যদি কোন ব্যক্তি তার অভ্যাস বা খাদ্য কমাতে সমর্থ হয়। কারণ এরফলে দেহের সুস্থতা ও বুদ্ধিবৃত্তির সুষ্ঠুতার উপর অনুকূল প্রভাব পড়ে।
যারা বিরাটাকার শক্তিমান পশুর মাংস আহার করে থাকে, তাদের বংশাবলিও তেমনি হয়ে উঠে। নগরবাসী ও প্রান্তরবাসীদের মধ্যে তুলনা করলেও এটা দেখতে পাওয়া যায়।
এমনিভাবে যারা উটের মাংস ও দুধ আহার করে, তাদের চরিত্রেও ধৈর্য, স্থৈর্য ও উটের ন্যায় ভার বহনের ক্ষমতা দৃষ্ট হয়। তাদের পাকস্থলীও উটের পাকস্থলীর ন্যায় সুস্থতা অসুস্থতার অভ্যাস গড়ে তোলে। ফলে দুর্বলতা ও অক্ষমতা তাকে স্পর্শ করতে পারে না। অন্যদের ন্যায় খাদ্যের অপকারিতা তাদের পাকস্থলীকে দুর্বল করে না। তারা কোন প্রকার মিশ্রণ ছাড়াই জোলাপের জন্য ক্ষার জাতীয় পদার্থ গ্রহণ করতে পারে। যেমন অপক্ক ‘হাজ্জাল’, ‘দেরিয়াস’ ও ‘কার্বিউন’ এগুলোতে তাদের পাকস্থলীর কোন ক্ষতি হয় না। এগুলো যদি কোন নগরবাসী, যার পাকস্থলী সুপাচ্য আহার্য গ্রহণের ফলে কোমল হয়ে গেছে, গ্রহণ করত, তা হলে চক্ষের পলকে তার মৃত্যু ঘটত। কারণ এসবগুলোতে বিষাক্ত পদার্থ বিদ্যমান।
তিনি আলোচনার শেষাংশে বলতে চেয়েছেন, দেহের উপর খাদ্যদ্রব্য প্রভাব বিস্তার করে থাকে। একইভঅবে ক্ষুধাও দেহের উপর প্রভাব বিস্তার করে। অনাহার যেমন দূষিত রক্ত ও দেহমনের ক্ষতিকর জৈবিক রস থেকে দেহকে পরিষ্কার রাখে, তেমনি পরিমিত আহার্যও দেহের অস্তিত্ব রক্ষায় প্রভাব বিস্তার করে থাকে।
আপনার মতামত লিখুন :