গিরিপুরে অনেক কালের নীরব সাক্ষী হয়ে দাড়িয়ে আছে সুউচ্চ এক প্রাসাদ।
প্রাসাদের উত্তর পার্শ্বদিয়ে কলকল ধ্বনীতে বয়ে গেছে পাহাড়ীয়া এক নদী। ড্রাগনের উপকথার দেশ এই গিরিপুর।
এই গিরিপুরে কালের সাক্ষী হয়ে দাড়িয়ে থাকা প্রাসাদে একদা হাতী শালায় হাতী, ঘোড়া শালায় ঘোড়া, মন্ত্রী, উজির, সেনাপতি, সৈন্য সামন্ত দিবারাত্রী পাহাড়ায় লোকারণ্যে ভরপুর ছিল।
অতীত জন্মের পূণ্যফলে অনেক শতাব্দী ধরে বংশ পরস্পরায় প্রজা প্রতিপালন করেছিলেন এই প্রাসাদের রাজারা। প্রজারা পাহাড়ের পর পাহাড় চষে, যাযাবর বেশে, শৈলকুঞ্জে, প্রকৃতির বৈরীতার মাঝে, হিংস্র পশুর সাথে লড়াই করে আর মৎস্য-পশু পাখী শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করতো।
রাজ দর্শন তারা পরম সৌভাগ্য বলে মনে করতো। তাই মোরগ-মুরগী, মধু, মদ্য, কাউন চাল ইত্যাদি ইত্যাদি উপঢৌকন নিয়ে বছরে একটিবার হলেও প্রজারা রাজ দর্শনে প্রত্যন্ত এলাকা থেকে পাহাড়ীয়া শ্বাপদিত সরূপথে কয়েকদিন ধরে হেটে গিরিপুরের রাজধানী এই প্রাসাদে আসতো। অনেকে বাদ্যযন্ত্র সহকারে নৃত্যগীত দল নিয়েও আসতো।
ক্রমে কালগত হয়। ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীরা নানা পণ্য নিয়ে এদেশে ব্যবসা করতে আসে। নানা উপঢৌকন নিয়ে রাজ দরবারে হাজির হয়। নানা চলচাতুরী আর চক্রান্তে এই দেশের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্বাধীন রাজ্যের শাসন ক্ষমতা কুক্ষিগত করে। যার ফলে গিরি পুরের রাজাদের ক্ষমতা ক্রমশঃ সংকোচন ও ম্লান হয়ে পড়ে।
এই প্রাসাদের কনিষ্ঠ রাজকুমার ছিলেন রাজ্য পরিচালনায় উদাসীন। আধুনিক শিক্ষা দীক্ষাকালে সুশিক্ষিত রূপসী এক মায়াবিনী দর্শনে মোহিত হয়ে পড়েন রাজকুমার। সেই রূপসী মায়াবিনীর সুমিষ্ঠ কন্ঠের বাচনভঙ্গী, অম্লান হাসী আর চপলা চাহনী রাজকুমারের হৃদয় কেড়ে নেয়।
সেই রূপসী মোহিনীর মায়াজালে রাজকুমার হয়ে পড়েন প্রেমের পাগল কবি, গীতিকার আর শিল্পী। অবশেষে রাজ কুমারের প্রেম স্বার্থক হয়। রাজ পুত্রবধু বেশে প্রাসাদে চলে আসে সেই মায়াভূজঙ্গিনী।
ব্রিটিশ গেলো, পাক গেলো, এলো বাংলার জমানা। প্রজাগণ রাজতন্ত্রের চেয়ে গণতন্ত্রের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ে বেশী। তাই সুশিক্ষিত রাজকুমার ও রাজপুত্রবধু রাজকার্য পরিত্যাগ করে দু’জনে সরকারী উচ্চ পদে যোগ দেয়। কিন্তু রাজ পুত্রবধু স্বপ্ন দেখে ব্রিটিশ সিংহাসনের।
নানা চক্রান্তে প্রাসাদ থেকে বিতাড়িত করে রাজ বংশের সব উত্তরাধিকারী। দু’জনে সরকারী উচ্চ পদে এবং প্রাসাদে রাজরানী হয়েও নেতৃত্ব আর ক্ষমতার লোভে রাজপুত্রবধু সরকারী উচ্চ পদ ত্যাগ করে যোগদেয় গণতন্ত্রের গণমিশিলে। মৌমাছির রানীর মতো দলবল নিয়ে ঘুরতে থাকে গিরিপুরের প্রতিটি পরতে।
অবশেষে বাংলার শাসনতন্ত্রের অন্যতম শালিশী কেন্দ্র সরোবর বেষ্টিত আধুনিক সুরম্য প্রাসাদের সভাসদ লাভ করে। ভূলে যায়-স্বামী, পুত্র-কন্যাসব ।
সাহিত্য সংস্কৃতিমনা রাজপুত্র স্ত্রীর এই হেন অবজ্ঞা আচরণে চিত্তের দহনে জ্বলতে থাকে। মদ্যপানে নিজেকে ক্ষয় করতে থাকে সদা। কিন্তু ক্ষমতা লোভী উচ্চাবিলাসীনীর সেদিকে কোন ভ্রুক্ষেপ নেই।
ব্রিটিশ সিংহাসনে বসার মানসে, সম্রাজ্ঞী হবার প্রত্যাশায় নানা চলচাতুরীতে একর পর এক প্রাসাদ বদলাতে থাকে। গিরিপুরের নিজের প্রাসাদের অনতিদূরে রাজ্য পরিচালনার জন্য গড়ে উঠেছে আরেক সুরম্য প্রাসাদ।
ক্ষমতালোভী মায়াভূজঙ্গিনী রাজপুত্রবধু ব্রিটিশ সিংহাসন নয়, অলংকৃত করে সেই প্রাসাদের শীর্ষ আসন। এক পান্ডা তের গুন্ডার ন্যায় বিচরণ করতে থাকে সর্বত্র । ট্রয়নগরী হেলেনা কিংবা লিবিয়া হবার মানসে আপন প্রজাদের ত্যাজ্য করে পরকে করে নেয় আপন ।
এই হেন কুচক্রে দগ্ধ হয়ে রাজপুত্র দুঃখের অনলে জ্বলতে জ্বলতে ইহ জগত ত্যাগ করে। এদিকে গণতন্ত্রের পালাবদলে সেই গণ প্রাসাদের সিংহাসনচ্যুত হয় সেই ক্ষমতালোভী কালনাগিনী রাজ পুত্রবধু।
প্রকৃতির যক্ষ্মঃপুরে থাকি, তথাপি নিঃস্ব কান্তারে কান্ডারী। একটিবারও হয়নি দেখা বহুকালের নীরব স্বাক্ষী হয়ে দাড়িয়ে থাকা সেই প্রাচীন প্রাসাদটি।
কৌতুহল বশত একদিন প্রত্যক্ষ করার মানসে গেলাম সেই প্রাসাদে। কিন্তু হাতী শালায় নেই হাতী, ঘোড়া শালায় নেই ঘোড়া, নেই মন্ত্রী, উজির, সেনাপতি, পাইক পেয়াদা, সবই শূন্য হাহাকার। শুধু দেখলাম যক্ষ্মঃপুরের রক্ষক হয়ে নির্জন প্রাসাদে সেই পাষাণীকে।
আজ হয়ত তার প্রচুর ধনদৌলত। কিন্ত নেই তার প্রিয় স্বজন, নেই সুখ আর শান্তি। ইন্টার না ড্রিগ্রীতে কোথায় যেন পড়েছি স্পষ্ট মনে নেই বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গল্প “ক্ষুধিত পাষাণ”। মনে হলো কালের সাক্ষী হয়ে দাড়িয়ে থাকা এই প্রাচীন প্রাসাদটিই রবী ঠাকুরের সেই ক্ষুধিত পাষাণ। কিন্তু এই পাষাণে রয়েছে এক যক্ষ্মঃ পাষাণী । এই পাষাণ থেকে যেন প্রতিধ্বনিত হচ্ছে সব ঝুট হায়! তফাৎ যাও।
** (ফি ল্যান্স সাংবাদিক উচ্চতমনি তঞ্চঙ্গ্যা বিগত ০৩ জুলাই ২০০৯ তারিখে আলীকদমের পানবাজাস্থ মৈত্রী কমপিউটারে বসে এই গল্পটি লিখেছিলেন।)
আপনার মতামত লিখুন :