॥ মমতাজ উদ্দিন আহমদ ॥
গত ৭ মে নীরবে-নিভৃতেই কেটে গেলো মাওলানা আবুল কালাম আজাদের ২৯তম মৃত্যুবার্ষিকী। পার্বত্য জনপদ বান্দরবানের আলীকদম উপজেলায় স্বাধীনতা পরবর্তীকালে ক্ষণজন্ম এই আলোকপ্রভার উদয় হয়েছিল।
মাওলানা আবুল কালাম আজাদের মৃত্যু পরবর্তী সময়ে তাঁর স্মৃতি সংরক্ষণের জন্য আলীকদমে ‘আজাদ স্মৃতি পাঠাগার’ নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা হয়। এ সংগঠনের পক্ষ থেকেও মহান এই মানুষটার স্মরণের কোন আলোচনা সভা কিংবা দোয়া মাহফিলের আয়োজন করা হয়নি।
মাওলানা আজাদ কে?
স্বাধীনতা পরবর্তীকালে পার্বত্য বান্দরবানের দুর্গম জনপদ আলীকদমে শিক্ষা এবং ধর্মীয় বৈভবে যে ক’জন আলোকপ্রভা জ্ঞানের মশাল জ্বেলেছিলেন তারমধ্যে অন্যতম ব্যক্তিত্ব ছিলেন মাওলানা আবুল কালাম আজাদ।
পার্বত্য জনপদ আলীকদমের বর্তমান প্রজন্মের অনেকেই তাঁর নামের সাথে পরিচিত নন। ১৯৯৫ সালের মৃত্যুর আগে পর্যন্ত পাহাড়ি এই জনপদে তিনি ‘বড় হুজুর’ নামে পরিচিত ছিলেন। এ উপজেলায় মুসলিম-অমুসলিম সব শ্রেণি পেশার মানুষের কাছে তিনি সমানভাবে সম্মানীয় ছিলেন।
ব্যক্তিত্বের পুষ্পিত গৌরব:
গোধুলী লগ্নের শান্ত বেলায় ফুটা কোন ফুল বা নীল অপরাজিতার মতই সংক্ষিপ্ত মানব জীবন। সুর্যের প্রদীপ্ত আভায় ফোটা কোন ফুল যেমনি বিশেষ সন্ধিক্ষণে ঝরে গিয়ে বিলিয়ে যায় অতৃপ্ত সৌরভ; ঠিক তেমনি কিছু মানুষ পৃথিবীতে রেখে যায় ব্যক্তিত্বের পুষ্পিত গৌরব।
মরহুম মাওলানা আবুল কালাম আজাদ ছিলেন এমনই এক আলোক প্রভা, যিনি ব্যক্তিত্বের গুণ, তীক্ষ্ম ধীশক্তি, অকৃত্রিম মমতা বলে অমর হয়ে থাকবেন ভক্তজনের স্মৃতির আঙিনায়।
স্মরণই গতি, বিস্মৃতি হলো নিস্তব্ধতা:
রাতের আকাশে লক্ষ তারা যেমনি হারিয়ে যায় প্রভাতের রক্তিমাভ সূর্যের স্পর্শ্বে, তেমনি মানব জীবনের এক একটি মূহুর্ত ক্রমহ্রাসিত হয় জীবনের উত্থাল ঢেউয়ের বিক্ষুব্ধ তরঙ্গে।
প্রখর সূর্যের প্রদীপ্ত তেজে রাতের লক্ষ তারা হারিয়ে হারিয়ে গেলেও শুকতারাটি যেমনি হারিয়ে যায়না, তেমনি কিছু মানুষের মায়াবী চেহারা ভেসে থাকে ভক্তজনের স্মৃতির আকাশে।
এসব মানুষ কে ইচ্ছায় ভোলা যায় না। তাদের স্মরণই গতি, বিস্মৃতি হলো নিস্তব্ধতা। আর এ গতির অনুগামী বলেই স্মরণ করছি পার্বত্য জনপদ আলীকদমের বিশিষ্ট আলেম, ইসলামী বিদ্যাপীঠের সার্থক রূপকার মরহুম মাওলানা আবুল কালাম আজাদকে।
বাল্য ও শিক্ষা জীবন:
মরহুম মাওলানা আবুল কালাম আজাদ ১৯৪১ সালে চকরিয়া উপজেলাধীন কাকারা ইউনিয়নের মাইজপাড়া (লোটনী) গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মোঃ কলিমূল্লাহ আর মাতার নাম আমেনা খাতুন। বাল্যকালে মাওলানা আজাদ স্থানীয় মক্তবে দরস নেয়ার পর প্রাথমিক শিক্ষা অর্জন করেন কাকারা তাজুল উলুম মাদ্রাসায়।
তৎপরবর্তীতে চকরিয়া আনওয়ারুল উলুম (সাহারবিল) মাদ্রাসার থেকে ১৯৬৩ সালে দাখিল পাস ও ১৯৬৭ সালে আলিম পাস করেন। পরে উচ্চশিক্ষার জন্য মা-বাবার একান্ত ইচ্ছায় চট্টগ্রামের পাঁচলাইশ ওয়াজেদীয়া আলিয়া মাদ্রাসায় ভর্তি হন। এ মাদ্রাসা হতে বিদ্যা শিক্ষার পাশাপাশি তিনি একান্ত সান্নিধ্য লাভ করেন উপমহাদেশের বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ মাওলানা আব্দুল জব্বার (রাহ.) এর।
স্মর্তব্য যে, বায়তুশ শরফের পীর মাওলানা আব্দুল জব্বার ১৯৫৪ সাল থেকে ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত একটানা ১৪ বছর ওয়াজেদিয়া আলিয়া মাদ্রাসায় হাদিস শরীফের অধ্যাপনা করেন।
মাওলানা আজাদ তাঁর অনুগত ছাত্র হওয়ার সুবাদে হাদিস শাস্ত্রের উপর প্রভূত জ্ঞান শিক্ষা করার সুযোগ পান। উক্ত মাদ্রাসা হতে তিনি ১৯৭০ সালে ফাজিল পাস এবং ১৯৭২ সালে হাদিস বিভাগে কামিল পাস করেন।
আলীকদমে আগমণ:
স্বাধীনতা পূর্বকাল থেকে পার্বত্য বান্দরবান জেলার আলীকদমে মাওলানা আবুল কালাম আজাদের পরিবারের কৃষিকাজ ছিল। তখনো চকরিয়া থেকে পার্বত্য জনপদ আলীকদমের সাথে সড়ক যোগাযোগ গড়ে উঠেনি। মাতামুহুরী নদীপথে এবং পাহাড়ি মেঠোপথে ছিল একমাত্র যোগাযোগ মাধ্যম।
পাহাড়ি জনপদ আলীকদমে তখনো বাঙ্গালী বসতির আধিক্য হয়নি। তৎকালীন পুরো আলীকদম ছিল ছিল একটি ইউনিয়নমাত্র। পুরো পার্বত্য আলীকদমে দু’চারটি বিচ্ছিন্ন মসজিদ ছাড়া কোন প্রকার ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেনি।
মাওলানা আবুল কালাম আজাদ ১৯৭২ সালে পারিবারিক প্রয়োজনে আলীকদম আসেন। তিনি আলীকদম উপজেলার অন্তর্বিহীন মৌন নিস্তব্দ সৌন্দর্য, ছায়াঘেরা, পাখিডাকা প্রাকৃতিক কোলাহল দেখে অভিভূত হন। তিনি সে সময় আলীকদমে অনেকদিন অবস্থান করেন।
ধর্মীয় শিক্ষা প্রসারে আত্মনিবেদন:
মাওলানা আবুল কালাম আজাদ ১৯৭২ সালে কামিল পাস করার পর অল্প কিছুদিন নিজ গ্রাম মাইজ কাকারায় অবস্থান করেন।
এ সময় পার্বত্য আলীকদমে দু’চারটি বিচ্ছিন্ন মসজিদ ছাড়া কোন প্রকার ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেনি। তিনি অনুভব করেত পারলেন এ অঞ্চলের ভবিষ্যৎ জনগোষ্ঠীর সম্ভাব্য ধর্মবিমুখতার এক বিরূপ প্রতিচ্ছবি। ধর্মীয় জ্ঞান প্রসারের একজন দিশারী হিসাবে এ বিরূপতার প্রতিচ্ছায়া তাঁর অন্তরকে নাড়া দেয়। তাঁর চিন্তা-চেতনায় আসে পরিবর্তন।
পরে আলীকদম উপজেলা সদর এলাকায় অবস্থিত আলীকদম বাজার মসজিদ (বর্তমানে কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ) দেখতে আসেন এবং তিনি উক্ত মসজিদে সুললিত কন্ঠের অপূর্ব উচ্চারণে একবেলা নামাজ পড়ান।
জানা গেছে, সে সময়কার সমাজহিতৈষী ও প্রবীণ ব্যক্তিবর্গ তাঁর আচরণে মুগ্ধ হয়ে তাঁকে উক্ত মসজিদের ইমামতির দায়িত্ব দেন। তৎমধ্যে হাজী ছাবের আহামদ চৌধুরী ও মকছুদ মিয়া চৌধুরী, হাজী আলীমুদ্দিন ও হাজী আনোয়ারুল ইসলাম এর নাম উল্লেখ্যযোগ্য।
এরপর হতে এ অঞ্চলে ইসলামের সুমহান শিক্ষা ছড়ানোর মহান ব্রত নেন মাওলানা আবুল কালাম আজাদ। অতঃপর তিনি মসজিদ সংলগ্ন তৎকালীন ছাবের মিয়ার দানকৃত জমির ওপর ১৯৭৮ ইং সালে একটি মক্তব চালু করেন।
পার্বত্য জনপদ আলীকদমের ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা গ্রামের মুসলিম ছাত্ররা সেখানে ক্রমান্বয়ে ভর্তি হতে থাকে। সময় ও কালের চাহিদার প্রেক্ষিতে এটিকে সম্প্র্রসারণ করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। সদ্য শিক্ষা সমাপ্ত টগবগে যুবক তখন আবুল কালাম আজাদ। কর্মস্পৃহা আর প্রাণপ্রাচুর্যের ঘাটতি ছিলনা তাঁর। তখনো আলীকদমের সাথে বাইরের থানাগুলোর যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল পায়ে হাটা মেটো পথ।
খরস্রোতা মাতামুহুরী নদীপথেই অধিকন্তু লোকজন যাতায়াত করতো । নাজুক যোগাযোগ ব্যবস্থায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সম্প্রসারণ নিয়ে তিনি মহা ফাঁপরে পড়লেন। তখনো আলীকদম ছিল সাবেক লামা থানার একটি ইউনিয়ন মাত্র।
পশ্চাৎপদ এলাকার আর্থিক দৈন্যদশা ও সামাজিক অস্বচ্ছলতা তাঁকে ভাবিয়ে তুললো। কিন্তু জ্ঞানকাননের ভ্রমরদের বিশ্রামের সময় কোথায়? এ অক্লান্ত কর্মবীর যেন ঘোষণা করলেন:
ওয়াক্ত ফুসরত হে কাঁহা আভি বাকী/ নুরে তাওহীদ্ কা এতমাম বাকী হে।
(নহে সমাপ্ত কর্ম তোদের, অবসর কোথা বিশ্রামের? উজ্জ্বল হয়ে ফুটেনি এখনো সুবিমল জ্যোতি তাওহীদের।) Ñ (আল্লামা ইকবালের শেকওয়া ও জওয়াবে শেকওয়া থেকে।)
বাস্তবিকই তাই।
তিনি হাঁটি পা পা করে ১৯৭৮ সালে গড়া সেই মক্তবকে মাদ্রাসায় রূপান্তর করার কাজে হাত দিলেন। তৎকালীন সমাজ সেবক ও শিক্ষানুরাগীরাও যোগ দিলেন এতে।
পার্বত্য জনপদ আলীকদমে ইসলামী শিক্ষা বিস্তারের এক যুগান্তকারী অধ্যায় সূচিত হলো তাঁর অকৃত্রিম সাধনায় গঠিত আলীকদম ইসলামীয়া মাদ্রাসা প্রতিস্থাপনের মধ্য দিয়ে।
এ প্রতিষ্ঠানটি বর্তমানে পুরো পার্বত্য আলীকদম উপজেলার একমাত্র ‘দাখিল মাদ্রাসা’ হিসাবে একটি আদর্শ ও সার্থক বিদ্যাপীঠের গৌরবে সমাসীন হয়ে আছে। এ মাদ্রাসা স্থাপনের পর হতে আমৃত্যু তিনি উক্ত প্রতিষ্ঠানের ‘তত্ত্বাবধায়ক’র পদ অলংকৃত করেছিলেন। মূলত: মাওলানা আবুল কালাম আজাদ তাঁর কর্মজীবন আলীকদম ইসলামীয়া দাখিল মাদ্রাসা ও আলীকদম কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ এর পৃষ্ঠপোষকতা নিয়েই অতিবাহিত করেন।
নন্দিত বক্তার ভূমিকায়:
মাওলানা আবুল কালাম আজাদ ছিলেন একজন কর্মনিষ্ঠ আদর্শ মানুষ। তাঁর কথা ও ধর্মীয় আঙ্গিকে প্রগতিশীল জীবন যাপন অপরকে অনুপ্রেরণা যোগাতো। তিনি ইসলামের সুমহান আদর্শের কথা বিভিন্ন ওয়াজে, মাহফিলে বক্তৃতা বয়ানের মাধ্যমে পৌঁছাতেন মানুষের কর্ণকুহরে।
আলীকদম ছাড়াও তিনি পার্বত্য চট্টগ্রাম, চকরিয়া ও কক্সবাজারসহ লোহাগাড়া, সাতকানিয়া এবং চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থানে মূল্যবান ওয়াজ-বক্তৃতায় কুরআন-সুন্নাহর অমিয় বাণী প্রচার করতেন। ওয়াজের সময় তাঁর সুললিত কণ্ঠের অপূর্ব সুরলহরীতে প্রজ্ঞাপূর্ণ আলোচনায় সকলে মোহিত ও মুগ্ধ হত।
তিনি ছাত্রাবস্থা হতে বিভিন্ন সেমিনার-সিম্পোজিয়াম ও ওয়াজ মাহফিলে আলোচনার অভ্যাস গড়ে তুলেছিলেন। তাঁর বিবিধ আলোচনায় ইসলামের সুবিমল কথার প্রকাশ ঘটত।
সকলের বড় হুজুর:
মাওলানা আবুল কালাম আজাদের জীবন পরিচালনা পদ্ধতি ছিল অনন্যসাধারণ। সরলতায় তিনি মহীয়ান, আন্তরিকতায় দীপ্যমান। অতিথি পরায়ণতায় তিনি ছিলেন বালকসুলভ খাদেম। তিনি অন্তরের বিশ্বাস কে মুখ দিয়ে প্রকাশ করে যেতেন অকপটে। পার্বত্য জনপদ আলীকদমের মুসলিম অ-মুসলিম ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলের কাছে তিনি সমগ্রাহ্য ছিলেন ‘বড় হুজুর’ আখ্যায়।
আদর্শ শিক্ষক : মুয়াল্লিমে খাইর:
মাওলানা আবুল কালাম আজাদ একনিষ্ঠ আদর্শ শিক্ষক ছিলেন। দাখিল মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার পর হতে ১৯৯৫ সালের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত তিনি এ মাদ্রাসায় প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন।
প্রত্যেক ছাত্রকে সুন্নাতে রাসুলের পাবন্দ মুবাল্লিগ হিসাবে গড়ে তুলতে তাঁর প্রচেষ্টার কমতি ছিলনা। দাখিল ক্লাসের ছাত্রদের তিনি কোরআন হাদিসের দরস দিতেন নিয়মিত। অল্প সময়ে তিনি কোরআনের তাফসীর আর হাদিসের বিশদ ব্যাখ্যা ছাত্রদের বুঝিয়ে দিতেন সযত্নে।
একজন সত্যিকার আলেম কে হাদিসে ‘মুয়াল্লিমে খাইর’ অর্থাৎ ‘কল্যাণ কর্মে নিয়োজিত শিক্ষক’ হিসাবে গণ্য করা হয়েছে। নবী করীম (স.) বলেন: “কল্যাণ কর্মে নিয়োজিত একজন শিক্ষক যখন মৃত্যূবরণ করেন তখন তাঁর জন্য আকাশের পাখিরা, পৃথিবীর অপরাপর বিচরণশীল প্রাণীরা এবং সমুদ্রের মৎস্যকুল ক্রন্দন করতে থাকে। (আততাফসীর”ল কবীর, ১ম-২য় খন্ড, পৃষ্ঠা- ১৮০)।
কর্মনিষ্ঠা ও আত্মনির্ভরশীলতার দৃষ্টান্ত:
তিনি সামগ্রিক জীবন পরিচালনায় এক আদর্শময় নীতি অবলম্বন করেছেন। কর্ম তৎপরতা ও আত্মনির্ভরশীলতায় ছিলেন একনিষ্ঠ। তাঁর কর্মস্থল তথা মাদ্রাসায় ফুলের বাগানে গাছের পরিচর্যা, এমনকি ঝাড়– দিয়ে পারিপার্শ্বিক স্থান পরিষ্কার করতেও কুণ্ঠাবোধ করেননি। কাজ করে গেছেন নিভৃতে। নিজ পরিবারের অনেক কাজ স্বহস্তে করে তিনি ধৈর্যের পরাষ্ঠা প্রদর্শন করেছেন।
মৃত্যু : হৃদয় গোলাপ গেলো ঝরে:
মাওলানা আজাদ দীর্ঘদিন ধরে পাকস্থলীর রোগে ভুগছিলেন। বয়স বাড়ার সাথে সাথে রোগও বাড়তে লাগলো। দীর্ঘ কর্মক্লান্তির পর তিনি যেন এক শান্ত বিরহী।
১৯৯৫ সালের শুরু থেকে মূলতঃ তাঁর দীর্ঘকালের জমাট বাঁধা রোগ বাড়তে শুরু করে। রোগ বৃদ্ধি হওয়াতে স্বীয় কর্মস্থল আলীকদম ইসলামীয়া মাদ্রাসা হতে চলে যান গ্রামের বাড়ি মাইজ কাকরা (লোটনী) তে। আর এ যাত্রা হলো তাঁর পার্বত্য আলীকদম থেকে চির বিদায়ের অন্তিম লগ্ন। সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে রোগ চললো বেড়ে। বাড়ির ছোট্ট এক খাটিয়ার শয্যাই হলো তাঁর সঙ্গী।
সবাই উদ্বিগ্ন কখন তাঁর জীবন প্রদীপ নিভে যায়। হায়! সবাইকে চলে যেতে হয়। ১৯৯৫ সালের এপ্রিলের শুরু থেকেই তাঁর শারীরিক অবস্থার মারত্মক অবনতি ঘটতে থাকে।
দু:সহনীয় এক শারিরীক যন্ত্রণায় বিধাতা যেন তার এক বান্দাকে পরীক্ষায় ফেললেন। তাঁর স্ত্রী-পুত্র আত্মীয় স্বজন এবং এ অধম ভক্তও তখন রাতদিন অবিশ্রান্ত সেবা করে। কিন্তু আল্লাহর পক্ষ থেকে বুঝি তিনি ডাক শুনতে পেয়েছেন:
يَـٰٓأَيَّتُهَا ٱلنَّفْسُ ٱلْمُطْمَئِنَّةُ ٢٧ ٱرْجِعِىٓ إِلَىٰ رَبِّكِ رَاضِيَةًۭ مَّرْضِيَّةًۭ ٢٨ فَٱدْخُلِى فِى عِبَـٰدِى ٢٩ وَٱدْخُلِى جَنَّتِى ٣٠
(বাংলা উচ্চারণ: ‘‘ইয়া আয়তুহান্নাফ্সুল মুত’মাইন্নাহ ইরজি’ঈ ইলা-রাব্বিকি রা-দি’য়াতাম্ র্মাদি’ইয়াহ।, ফাদ্খুলী ফী ‘ইবা-দি। ওয়াদ্খুলী জান্নাতি।”
(অর্থঃ ওহে প্রশান্ত আত্মা! প্রত্যাবর্তন কর তোমার রবের দিকে সন্তোষ সহকারে, আর তিনি তোমাদের প্রতি সন্তুষ্ট। অতএব, আমার বান্দাদের অন্তর্ভূক্ত হয়ে যাও এবং জান্নাতে প্রবেশ কর।) [সুরা আল ফজর]
৭ মে, ১৯৯৫ সাল। দুপুর ২টা ২৫ মিনিট। ইহকালের মায়া ত্যাগ করে সর্বস্ব রেখে মাওলানা আবুল কালাম আজাদ চলে যান মহান প্রভূর সান্নিধ্যে। শোকাহত মানুষের উপচে পড়া ভীড়ে প্রকম্পিত হলো মরহুমের বাড়ির আঙ্গিনা। তাসবিহ-তাহলিল, কোরআন তেলাওয়াতের অবিরত গুঞ্জনে এক স্বর্গীয় পরিবেশ সৃষ্টি হলো।
আজ এক্ষণে হৃদয়ের এক অতৃপ্ত আহ্বানে, বেদন বিধুর উচ্চারণ:
“যেখানে তুমি নেই সেখানে জরে দু’চোখে শ্রাবণের ধারা,
যেখানে তুমি নেই সেখানে আমরা হয়েছি সর্বহারা।
যেখানে তুমি নেই সেখানে হাহাকার করে কষ্টের মরু-ভূ,
যেখানে তুমি নেই সেখানে উঠে শোকের মাতম শুধু।”
লেখক: মমতাজ উদ্দিন আহমদ, সভাপতি, আলীকদম প্রেসক্লাব, ও প্রতিষ্ঠাতা: আজাদ স্মৃতি পাঠাগার, আলীকদম, বান্দরবান পার্বত্য জেলা।
তারিখ: ১২ মে ২০২৪।
আপনার মতামত লিখুন :