|| মমতাজ উদ্দিন আহমদ ||
আত্মা কি? জীবনের সাথে আত্মার সম্পর্ক কি? এ নিয়ে বিজ্ঞান, চিকিৎসা বিজ্ঞান ও ধর্মের মাঝে মূলগত পার্থক্য আছে। তবে পবিত্র কুরআনের আলোকে যখন আমরা আত্মার সংজ্ঞা খুঁজি তখন বিষয়টি পরিস্কারভাবে বুঝতে পারি এভাবে-
“ওয়া ইয়াছ্ আলুনাকা ‘আনির রূহি’ কুলির্ রূহু মিন্ আম্রি রাব্বী ওয়ামা ঊতীতুম্ মিনাল্ ‘ইল্মি ইল্লা- কা’লীলা।”
অর্থাৎ- তোমাকে তারা রূহ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে। বল, ‘রূহ হচ্ছে আমার প্রতিপালকের হুকুমের অন্তর্ভুক্ত (একটি হুকুম)। এ সম্পর্কে তোমাকে অতি সামান্য জ্ঞানই দেয়া হয়েছে।’ (সুরা বনী ইসরাইল, আয়াত ৮৫।)
দার্শনিক ইমাম গাজ্জালী তাঁর রচিত ‘কিমিয়ায়ে সা’আদাত’ গ্রন্থে পবিত্র কুরআনে উল্লেখিত ‘রূহ’ বলতে আত্মাকেই বুঝিয়েছেন। পবিত্র কোরআনে অন্তত ২৩ বার ‘রুহ’ শব্দ এসেছে।
তাফসিরে আহসানুল বয়ানে বলা হয়েছে, রূহ বা আত্মা এমন অশরীরী বস্তু যা কারো দৃষ্টিগোচর হয় না। কিন্তু প্রত্যেক প্রাণীর শক্তি ও সামর্থ্য এই রূহের মধ্যেই লুক্কায়িত। এর প্রকৃত স্বরূপ কি? তা কেউ জানে না। ইয়াহুদীরাও একদা নবী করীম (সাঃ)-কে এ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে এই আয়াত অবতীর্ণ হয়।’
তাফসিরে জাকারিয়ায় দেখা যায়, ‘রূহ শব্দটি অভিধান, বাকপদ্ধতি এবং কুরআনে একাধিক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। প্রসিদ্ধ ও সুবিদিত অর্থ তাই, যা এ শব্দ থেকে সাধারণভাবে বোঝা যায়। অর্থাৎ- প্ৰাণ যার বদৌলতে জীবন কায়েম রয়েছে।’
ওপরের আয়াতে বর্ণিত ‘রূহ’ শব্দটি যে আত্মাকে বুঝানো হয়েছে সে ব্যাপারে সবচেয়ে প্রণিধানযোগ্য একটি বর্ণনা পাওয়া যায় হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণিত একটি হাদীস থেকে। হাদীসটি বর্ণিত হয়েছে সহিহ বুখারীর ১২৫ এবং সহীহ মুসলিমের ২৭৯৪ নাম্বার হাদীসে। এ হাদীসের সারাংশ এই, একজন ইহুদী মুহাম্মদ (সা.) কে রূহ কি জিজ্ঞেস করার পর আল্লাহর রাসুল (সা.) খানিক চুপ করে রইলেন। পরে উপরের আয়াতটি নাজিল হয়।
তবে কোন কোন তফসীরবিদ বর্ণনার পূর্বাপর ধারার প্রতি লক্ষ্য করে ‘রূহ’ শব্দটি ওহী, কুরআন অথবা ওহীবাহক ফেরেশতা জিবরীল সম্পর্কে সাব্যস্ত করেছেন। যেমন: তাফহিমুল কুরআনে রূহ বলতে ওহী, নবুওয়ত ও জিব্রাইল (আ.) কে বুঝানো হয়েছে।
রূহ্ বা আত্মা কি?
বাংলা ভাষায় রূহ এর অর্থ হলো প্রাণ বা আত্মা। পবিত্র কোরআনে রূহ শব্দটি তিনটি অর্থে দেখা যায়। এক. ‘রুহ’ হলো সেই অলৌকিক বস্তু, যা মানুষের ভেতর ফুঁ দিয়ে প্রাণের সঞ্চার করা হয়। দুই. কুরআনে রূহ শব্দটি জিবরাইল (আ.)-এর জন্য ব্যবহৃত হয়েছে। তিন. রূহ শব্দ কয়েকটি জায়গায় কোরআন ও ওহি বোঝানোর জন্য ব্যবহৃত হয়েছে। রূহ বা আত্মা দৃষ্টিগোচর হয় না। অথচ মানুষসহ প্রত্যেক প্রাণের শক্তি ও সামর্থ্য এই আত্মার মধ্যেই লুকায়িত।
রূহ্ বা আত্মা’র বিষয়ে কুরআনের উপরের বর্ণনা ছাড়া বিশদ কিছু বর্ণনা করবার অনুমতি শরীয়তে তেমন একটা খুঁজে পাওয়া যায় না।
রূহ্ বা আত্মার স্বরূপ সন্ধান বক্ষ্যমান প্রবন্ধের মূল লক্ষ্য। তাই রূহ্ নিয়ে আলোচনায় ব্যাপৃত থাকতে চাই। রূহ্ মানে আমার ‘আমি’। মানুষের মাঝে আভ্যন্তরিণ একটি বস্তুই রূহ্। রূহ আরবী শব্দ। ‘নফস্’ শব্দটিও রূহ্ শব্দের প্রতিশব্দ। পবিত্র কুরআনে ‘রুহ’ এবং ‘নফস্’ শব্দ দু’টি একই অর্থে ব্যবহার হতে দেখা যায়। ফার্সিতে ‘দিল’ বাংলায় ‘হৃদয়’ বা ‘মন’ বলা হয়। রূহ্ সম্পর্কে আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেন-
অর্থাৎ- শরীরের মধ্যে একটি মাংসের টুকরা আছে, তা যখন ঠিক হয়ে যায়, গোটা শরীরই তখন ঠিক হয়ে যায়। আর তা যখন খারাপ হয়ে যায়, গোটা শরীরই তখন খারাপ হয়ে যায়। জেনে রাখ, সে মাংসের টুকরোটি হল আত্মা। (সুনানে বায়হাকী, হাদীস নং- ১০১৮০)
ইমাম গাজ্জালী বলেন, মানুষের বক্ষস্থলের ভিতরে বাম পার্শ্বে এক টুকরা গোশত আছে। মানুষের মূল বস্তু দিল বা আত্মা চর্মচক্ষে দেখা যায় না। যা চর্মচক্ষে দেখা যায় তা জড়জগতের অন্তর্গত। আত্মা জড়জগতের পদার্থ নয়।
এই বিশ্ব চরাচরে আত্মার আগমণ মুসাফির হিসেবে। মুসাফির যেমন নির্দ্ধিষ্ট গন্তব্য সফর করে তার আসল জায়গায় ফিরে, তদ্রুপ আত্মাও দুনিয়ার জীবন পরিভ্রমণ শেষে আত্মার জগতে চলে যায়। যেটাকে ইসলামে ‘আলমে আরওয়াহ’ বা আত্মার জগৎ বলা হয়েছে।
ভালো-মন্দের ভেদজ্ঞান:
রূহ্ বা আত্মাই মানুষকে ভালো বা মন্দ পথে পরিচালিত করে। মানুষের সমস্ত শরীরই রূহের অধীন। ধর্মগ্রন্থের সমুদয় আদেশ-নিষেধ মূলতঃ রূহ বা আত্মাকে কেন্দ্র করেই আরোপিত হয়েছে। এই রূহ্ ঠিক থাকলে মানুষ আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করতে পারে। এই ধরাধমের যেকোনো মানুষ রূহের দ্বারা সংগঠিত সৎগুণাবলীর কল্যাণে মঞ্জিলে মকছুদে পৌঁছে যেতে পারে। এ ঘোষণা এসেছে সূরা ফাজরের শেষের ৪টি আয়াতে। কুরআনে প্রশান্ত আত্মাকে ‘নাফসে মুতমায়িন্নাহ’ বলা হয়েছে।
মানুষ এই জগতে নিতান্তই মুসাফির। মায়ের গর্ভাশয়ে যখন একটি রূহের আবির্ভাব ঘটে তার নড়াছড়া আধুনিক আলট্রাসোনোগ্রাফিতে দেখলে অবাক হতে হয়। একটি রূহ পৃথিবীতে আসার আগে তার ওই রূহের বাহ্যিক অবয়বের প্রাথমিক রূপ মায়ের গর্ভে কেমন হয় তা আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান শনাক্ত করতে পারে।
ধর্মতাত্বিক দার্শিনকরা বলেন, মানুষের মধ্যে যে রূহ থাকে তার স্বভাবই মূলতঃ আল্লাহর মারিফাত লাভ ও স্রষ্টার অতুলনীয় সৌন্দর্যদর্শন লাভ করা। আল্লাহর বন্দেগী করার দায়িত্বভারও এই রূপের ওপর ন্যস্ত। রূহ সমস্ত জগৎ সংসারে অতিশয় উৎকৃষ্ট রত্ন। মহান আল্লাহর দরবারেই রূহের উৎপত্তি স্থান।
মৃত্যুর পর প্রশান্ত রূহ বা নফস্ আল্লাহর দরবারে ফিরে যায়। পবিত্র কুরআনের সূরা ফজরের ২৭-৩০ নং আয়াত হচ্ছে প্রশান্ত আত্মা বিষয়ক আয়াত। এখানে বলা হয়েছে-
‘হে প্রশান্ত আত্মা!, তুমি তোমার প্রতিপালকের নিকট ফিরে এস সন্তুষ্টচিত্তে ও সন্তোষভাজন হয়ে, আমার বান্দাদের অন্তর্ভূক্ত হও এবং আমার জান্নাতে প্রবেশ কর।’
যে ব্যক্তি প্রশান্ত আত্মার অধিকারী হবেন তিনি আল্লাহর প্রতিদানে সর্বদা সন্তুষ্ট থাকবেন। এ ধরণের ব্যক্তির ওপর আল্লাহও সন্তুষ্ট থাকেন। কারও কারও মতে মু’মিনদের মৃত্যুর সময় আল্লাহ এ আহ্বান জানান।
আত্মার রকমফের:
রূহ-আত্মা-হৃদয় বা মন একেকজনের বেলায় একেক মর্জি বহন করে চলা একটি বস্তু। অকারণে এই হৃদয় কাউকে হাসায়, কাউকে কাঁদায় আবার কাউকে নাচায়! বলা হয়ে থাকে হৃদয় বা আত্মার অধীন পুরো মানব শরীর! মানুষের অধীন নয় আত্মা। নইলে বলা নেই, কওয়া নেই হঠাৎ মানুষ এমন আজগুবি কান্ড ঘটায় কেন? যেমন- ‘এই মন যা চায়’ তা-ই করে বসে কোনো কোনো মানুষ। এই মন তার কাজ ভুলে যায়। অতীত ভুলে যায়। স্রষ্টাকে ভুলে যায়। হঠাৎ হঠাৎ ‘এই মন যা চায়’ কে প্রধান্য দিতে গিয়ে কি করে হুশ হারিয়ে ফেলে।
রূহ্ বা আত্মার বিষয়ে দার্শনিক আলোচনা করতে গেলে দেখা যায়, একজন মানুষের শরীরের যা আছে তা সমস্তই রূহের অধীন।
আত্মাকে জানার আহ্বান:
পবিত্র কুরআনে রূহ বা আত্মা কি তা ওপরে বর্ণিত হয়েছে। সক্রেটিস বলেছেন “নিজেকে জানো”। আরবীতে আছে- মান্ আরাফা নাফসাহু ফাক্বাদ্ আরাফা রাব্বাহু’ অর্থাৎ ‘যিনি নিজেকে চিনেছেন, তিনি স্রষ্টাকে চিনেছেন।’ একজন মানুষ আত্মার অস্তিত্ব না বুঝা পর্যন্ত তার প্রকৃত তত্ব জানতে পারে না।
ভারতীয় দার্শনিক ঐতিহ্য হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন ও শিখ ধর্মে আধ্যাত্মিক মুক্তি বা মোক্ষ অধ্যায়ন করলে জানা যায়, আত্মকে জানাই হচ্ছে মোক্ষের মূল নীতি। হিন্দুধর্মের তাত্ত্বিক ভিত্তি নিয়ে আলোচিত ধর্মগ্রন্থ উপনিষদে বলা হয়েছে, ‘আত্মানাং বিদ্ধি’। এটা অনুবাদ করলে হয়, ‘নিজেকে জানো’। এটি উপনিষদ দর্শণের ভিত্তি।
এসব ভারতীয় ধর্মে ‘মোক্ষ’ বা বিমোক্ষ বা বিমুক্তি হচ্ছে আত্মার মুক্তি প্রসঙ্গে একটি অতিশয় গুরুত্ববহ একটি শব্দ। এই শব্দে পরকাল বিষয়ক ধারণা দেওয়া হয়েছে। দুঃখ, মৃত্যু ও পুনর্জন্মের চক্র (সংসার) থেকে প্রকৃত জ্ঞানের মাধ্যমে মুক্তি বুঝাতে ‘মোক্ষ’ শব্দের অর্থ জানা ভারতীয় দর্শনের অন্যতম ভিত্তি।
এই বিশ্বচরাচরে যা কিছু আছে তাদের মধ্যে সবচেয়ে আত্মার নিকটবর্তী হচ্ছে মানবদেহ। দেহের ভেতরে-বাইরের পরিপূর্ণ রূপ, রোগ-শোক মানুষ নিজেও বুঝতে পারে না।
ইমাম গাজ্জালীর মতে, মানুষ নিজের হাত, পা, মুখ, মাথ ও মাংসপেশীর অধিক আর আর কিছুই প্রকৃতপক্ষে চিনতে পারে না। আর শরীরের অভ্যন্তরীণ অংশে ক্ষুধা লাগলে আহার করা আর অন্যবিধ ইচ্ছে জাগ্রত হলে তা চরিতার্থ করা ছাড়া মানুষ আর কিছু পারে না।
আমি কে? কোথা থেকে কেন আসলাম? আমার অস্তিত্ব আগে কোথায় ছিল? এসব প্রসঙ্গের আলাপ খুবই বিস্তর। তবে আত্মার দ্বারা পরিচালিত হলেও কিছু মানুষ চতুষ্পদ জন্তু ও হিংস্র প্রাণীর চেয়েও হিংস্র হতে পারে। অন্যভাবে বলা চলে এই আত্মার কিছু গুণাবলী ফেরেশতার আর কতকগুলি শয়তানের।
আল্লাহ মানুষকে যে রূপে সৃষ্টি করেছেন তার মধ্যে মানুষের বাহ্যিক রূপ বা অবয়বটি দেখা যায়। কিন্তু ভেতরের রূপ অর্থাৎ রূহ বা আত্মাকে স্বয়ং মানুষও দেখতে পারে না। আত্মার দর্শন চর্মচক্ষুর পক্ষে সম্ভব নয়।
আত্মা এবং শরীর সম্পূর্ণ ভিন্ন জিনিস। মারা গেলে মানুষের শরীরটি পড়ে থাকে। আত্মা খোঁজ আর কেউ পায় না। কুরআনের ভাষায়-
‘রূহ বা আত্মা হচ্ছে আমার প্রতিপালকের হুকুমের অন্তর্ভুক্ত (একটি হুকুম)। এ সম্পর্কে তোমাকে অতি সামান্য জ্ঞানই দেয়া হয়েছে।’ (সুরা বনী ইসরাইল, আয়াত ৮৫।)
সুতরাং এ বিষয়ে রূহানী জ্ঞান ছাড়া অতিরিক্ত আলোচনা ঈমানহীনতার দিকে নিয়ে যাবে। তবে এক্ষেত্রে ইমাম গাজ্জালী তার দার্শনিক তত্ত্বে বলেছেন- কেউ যদি চোখ বন্ধ করে কল্পনায় নিজের শরীর, দুনিয়া ও দুনিয়াতে যাহা কিছু আছে সব ভুলে যায় তবে নিজ অস্তিত্ব সে অবশ্যই বুঝতে পারবেন। তখন সে ব্যক্তি নিজ শরীর, দুনিয়া ও দুনিয়াতে যা কিছু আছে সব ভুলে গেলেও নিজে যে বর্তমান আছে তাতে তার কোন সন্দেহ থাবে না। এ ধরণের গভীর মনোনিবেশ মানুষকে পরকাল সম্বন্ধেও জ্ঞান দিতে পারে।
আপনার মতামত লিখুন :