সাংবাদিকতার বৈশিষ্ট্য


Momtaj Uddin Ahamad প্রকাশের সময় : মার্চ ৯, ২০২৩, ৬:১০ পূর্বাহ্ন /
<strong>সাংবাদিকতার বৈশিষ্ট্য</strong>

সাংবাদিকতার প্রথম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে : লোকসেবা

মানুষের কাজে আসে বা কাজে লাগতে পারে এমন তথ্য বা সত্য বচন অত্যন্ত তৎপরতার সঙ্গে জোগাড় করে, যাচাই-বাছাই সেরে, তার সঙ্গে প্রয়োজনীয় মূল্যসংযোজন করে ঝটপট মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দেয়ার কাজটিই হচ্ছে সাংবাদিকতা।

সাংবাদিকরা নিজেরাই দাবি করেন, তারা কাজ করেন পাহারা দেয়া কুকুরের মতো। গৃহস্থের বাড়ির দেয়ালের ভেতরে অনাকাঙ্ক্ষিত কেউ ঢুকলে তো বটেই, পাতা ঝরার শব্দ হলেও চিৎকার করে ওঠে যে কুকুর, তারই মতো হতে হয় সাংবাদিককে। জনস্বার্থ বিঘ্নিত করতে কেউ ঢুকলে বা কারও ঢুকে পড়ার শঙ্কা তৈরি হলেই হইচই বাধিয়ে দেয় সে।

সাংবাদিকতায় লোকসেবা

সাংবাদিকতার দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে : বস্তুনিষ্ঠতা

সাংবাদিকতা হবে পক্ষপাতিত্বশূণ্য স্বচ্ছ, বিশ্বাসযোগ্য এবং এসব মেনে চলার মধ্য দিয়ে সাংবাদিকতাকে বজায় রাখতে হবে বস্তু‘নিষ্ঠতা। বাংলা ভাষায় তথ্যশব্দটির মধ্যে রয়ে গেছে সত্য রক্ষার বিষয়টি। যা সত্য নয়, তা তথ্য নয়। সুতরাং পৃথকভাবে সত্যতা বা সত্যনিষ্ঠতা রক্ষার বিষয়টি বস্তুনিষ্ঠতার আলোচনায় উল্লেখ না করলেও চলে।

সাংবাদিকতার তৃতীয় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে : তাৎক্ষণিকতা

সাংবাদিকতাকে হতে হবে ক্ষণকালজয়ী। সাংবাদিকতাকে বজায় রাখতে হবে তাৎক্ষণিকতা। অতিদ্রুত তৎপরতার সঙ্গে কাজ করতেই হবে সাংবাদিককে। এ বৈশিষ্ট্য̈ই সাংবাদিকতাকে দিয়েছে অনন্যতা। কোন কাজকে সাংবাদিকতা বলা যাবে, আর কোন কাজকে সাংবাদিকতা বলা যাবে না তার অন্যতম নির্ণায়ক হচ্ছে সাংবাদিকতা পেশায় সময়কে জয় করার শর্ত। আর সব কর্মকান্ডেই কর্তা কর্ম সম্পাদনের জন্য নিজের মতো করে সময় পিছিয়ে নির্ধারণ করতে পারে, কিন্তু সাংবাদিকতায় সে পথ রুদ্ধ।

সাংবাদিকতায় তাৎক্ষণিকতা

সাংবাদিকতার চতুর্থ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে : প্রায় সুনির্দিষ্ট নীতি-নৈতিকতা

আগে থেকেই নির্ধারিত এ নীতি-নৈতিকতা বজায় রাখতে গিয়ে সাংবাদিকতা হয়ে ওঠে নিরাসক্তভাবে তথ্য যাচাই-বাছাইয়ের এক বিদ্যা। সাংবাদিকতাকে সর্বদা সতর্ক থাকতে হয় আত্মপ্রবণঞ্চনার ফাঁদে যেন সাংবাদিকতা আটকে না যায়, সে ব্যাপারে। তার কৃতকর্মে অন্যের উপকার যেমন নিশ্চিত করতে হয়, তেমনি নিশ্চিত করতে হয় কোনোভাবেই যেন কোনো পক্ষ অহেতুক ক্ষতির শিকার না হয়।

সাংবাদিকতায় নীতিনৈতিকতা

সাংবাদিকতার পঞ্চম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে : তথ্য উপস্থাপনের অনিবার্যভাবে আকর্ষণীয় প্রক্রিয়া

সাংবাদিকতা একের পর এক তথ্য বা ঘটনা উল্লেখ করে যাওয়ার কাজ নয়। সাধারণ জ্ঞানের বইয়ে যেভাবে তথ্য সাজানো থাকে, তেমনভাবে তথ্য এখানে সাজানো হয় না। বরং এমনভাবে তথ্য সাজাতে হয়; যেন মানুষ সহজেই আকৃষ্ট হয়। চিত্তকে দ্রুত আকৃষ্ট করবে, মাথায় সরাসরি আঘাত হানবে, মুহূর্তেই মননকে প্রভাবিত করতে পারবে এমনভাবেই সাংবাদিকতায় উপস্থাপিত হতে হবে তথ্য।

সাংবাদিকতার ষষ্ঠ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে : শুধু গুরুত্বপূর্ণ ও প্রাসঙ্গিক তথ্য উপস্থাপন

দর্শক-শ্রোতা-পাঠক জানতে চান এমন তথ্য বা তারা এখনও অনুমান করতে পারেননি, কিন্তু তাদের জানা প্রয়োজন এমন তথ্য পরিবেশনের কাজটাই হচ্ছে সাংবাদিকতা। একজন প্রতিবেদক শুধু গুরুত্বপূর্ণ ও প্রাসঙ্গিক তথ্যগুলোই উপস্থাপন করে থাকেন এমন কিছুই সংবাদে থাকতে পারে না, যা না থাকলেও চলত।

সাংবাদিকতার সপ্তম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে : তথ্যগুলোর সর্বাত্মকতা ও আনুপাতিক যথার্থতা

সাংবাদিকতাকে হতে হবে মানচিত্রের মতো কার্যকর। সাংবাদিকতার মানচিত্র দেখেই একজন পাঠক-দর্শক-শ্রোতা গণতান্ত্রিক সমাজে কীভাবে চলাচল করতে হয়, কীভাবে যথাযথ ভূমিকা রাখতে হয়ে, তা সার্বক্ষণিক জানতে পারবে।

সাংবাদিকতার ভোক্তারা বুঝতে পারবে, কোন তথ্যটির তুলনামূলক গুরুত্ব কী বা কেমন। সাংবাদিক যদি অপূর্ণাঙ্গ তথ্য দেন, তাহলে তার কাজটিকে সাংবাদিকতা বলা যাবে না। কোনো একটা বিষয় বা ইস্যুর প্রাসঙ্গিক সব তথ্য ভোক্তাকে জানাতে পারার মধ্যেই নিহিত রয়েছে সাংবাদিকতার সার্থকতা।

সাংবাদিকতায় তথ্যগুলোর সর্বাত্মকতা

সাংবাদিকতার অষ্টম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে : সুরুচি

যোগাযোগের অন্যান্য শৈলীর মধ্যে সাংবাদিকতায়ই তর্কহীনভাবে সুরুচি রক্ষা করার বাধ্যবাধকতা থাকে। এ ‘সুরুচি’র বিষয়টি কী, সে নিয়ে নানা মত ও বিতর্ক রয়েছে। তবে সাংবাদিকতায় সুরুচির সংজ্ঞা মোটামুটি পরিষ্কার। সংশ্লিষ্ট গণমাধ্যমের দর্শক-শ্রোতা-পাঠকের অধিকাংশ মানুষ যাকে সুরুচির পরিচায়ক মনে করবে, সেটিই সুরুচি।

সাংবাদিকতায় সুরুচি

প্রশ্ন উঠতে পারে সাংবাদিক অধিকাংশ মানুষের মনের কথা জানতে পারবেন কীভাবে? উত্তর হচ্ছে, যে যোগ্যতায় তিনি অধিকাংশ মানুষের আগ্রহের বিষয় কী, তা অনুমান করে নিয়ে সে বিষয়ে সংবাদ পরিবেশন করেন, একইভাবে তাকে কীসে সুরুচি রক্ষা হয়, সেটিও অনুমান করে নিতে হয়। খুব সরলভাবেও একজন সাংবাদিক সুরুচি রক্ষা করার বিষয়টি নিশ্চিত করতে পারেন।

তিনি খবরটি তৈরি করার সময় শুধু খেয়াল রাখবেন তার মা-খালারা খবরটি দেখতে গেলে অস্বস্তিবোধ করবেন কিনা? যদি তাদের অস্বস্তি হবে না বলে আপনি নিঃসংশয় হন, তবে জানবেন, আপনার সংবাদে রুচিশীলতা রক্ষা হয়েছে।

সাংবাদিকতা হচ্ছে অব্যাহতভাবে মানুষের কাজে আসতে পারে এমন তথ্য যাচাই-বাছাইয়ের বিদ্যা। এ কথা ভুলে গেলে চলবে না, সাংবাদিকতা শুধু তথ্য তুলে ধরে না, সে তুলে ধরে তথ্যের সত্যতা।

Journalism can be distinguished from other activities and products by certain identifiable characteristics and practices. These elements not only separate journalism from other forms of communication, they are what make it indispensable to democratic societies. History reveals that the more democratic a society, the more news and information it tends to have.

আসলে তারা যেটা করেন তা হচ্ছে, ‘সাংবাদিকতা কী’ এ প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে তারা বলেন, এ মনুষ্য সমাজে ‘সাংবাদিকতা’ কী করে বা ‘সাংবাদিকতা’ কী করতে চায় আর এ করার প্রক্রিয়াটি কী হওয়া উচিত।

সাংবাদিকতা খুব জায়মান একটা প্রপঞ্চ। মানুষের সমাজে হাতে হাত রেখে সে বদলে যায় সমাজেরই মতো, প্রতিনিয়ত। ফলে ‘সাংবাদিকতা’ তো সবসময় একই কাজ করে না বা করতে পারে না। সবসময় একই রকম ভূমিকা রাখতে পারে না বা রাখতে চায় না। নানা কারণে সাংবাদিকতার কাজের প্রক্রিয়াও আগের মতো থাকে না।

সুতরাং ‘সাংবাদিকতা কী’ এ প্রশ্নের চিরায়ত একটা উত্তর দিতে গেলে সাংবাদিকতার চর্চাকারীরা নিজেরাই কিছুটা দ্বন্দ্বে পড়ে যান। সমাজের অনেকেই রে রে করে ওঠেন কেন স্ববিরোধী কথা বলা হচ্ছে। এ অবস্থায় তারা ‘আসল সাংবাদিকতা’র সংজ্ঞা ঠিক করে দিতে তৎপর হয়ে ওঠেন।

সাংবাদিকদের আত্মমর্যাদার জন্য এ পরিস্থিতি হানিকর হয়ে ওঠে। তাই সাংবাদিকতাকে তারা শুরু থেকেই চেষ্টা করেছেন কিছু বৈশিষ্ট্যের আলোকে শনাক্ত করতে। নিজেদের কাজে এ বৈশিষ্ট্যগুলো বজায় থাকলেই সাংবাদিকরা শুধু তাদের কাজকে সাংবাদিকতা বলে জানেন।

পাশাপাশি মূল বৈশিষ্ট্যগুলো যে ঠিক আছে, এটি প্রমাণ করতে তাদের সর্বক্ষণ সচেষ্ট থাকতে হয়, নিজেদের পক্ষে যুক্তিতর্ক তুলে ধরতে হয়।

এ কারণেই সাংবাদিকরা বলেন, সাংবাদিকতায় এ একটি আইনই মাথায় রাখতে হয় সাংবাদিকতায় কোনো আইন নেই। সাংবাদিকতা সদাসর্বদা শুধু যুক্তি মেনে চলে। কান্ডজ্ঞানই তার প্রধান চালিকাশক্তি, কান্ডজ্ঞানই তার টিকে থাকার সহায়।

উপরের অপেক্ষাকৃত জটিল আলোচনাটুকু করতে হলো এটুকু বোঝানোর জন্য যে, আপনি যখন সাংবাদিকতায় থাকবেন, অনেক সময়ই শুনবেন, আপনি যা করছেন তা ‘আসল সাংবাদিকতা’ নয় বা সমাজের অন্যান্য ক্ষেত্রের পণ্ডিতরা সাংবাদিকতার ভিন্ন ভিন্ন পরিচয় আপনাদের কাছে তুলে ধরবেন।

কখনও কখনও আপনি নিজেও দ্বিধায় পড়ে যাবেন; কিন্তু মনে রাখবেন সাংবাদিকতায় যারা জড়িত, তাদের কাছে সাংবাদিকতার সংজ্ঞাটা তাদের নিজেদের মতো করেই তৈরি করা। বেশকিছু শর্ত দিয়ে ওই সংজ্ঞাটি নির্মিত।

মূল প্রবন্ধ: খ. আলী আর রাজী, অনুলিখন: মমতাজ উদ্দিন আহমদ।