|| মমতাজ উদ্দিন আহমদ ||
রবীন্দ্রনাথের পোস্টমাস্টার গল্পের অনাথিনী রতন ভেবেছিল ‘পোস্টমাস্টার’ আবার ফিরে আসবেন। এই গ্রাম্য বালিকার মন ছিল সহজ-সরল। সে সম্পর্কের জটিল সমীকরণ ও পৃথিবীর কোন জটিল তত্ব বুঝতো না। তাই পোস্টমাস্টার তাকে ছেড়ে গেলেও বারবার মনে হচ্ছিল দাদাবাবু পোস্টমাস্টার তার কাছে ফিরে আসবেন। সেই আশাতেই পোস্টঅফিসের চারপাশে কেঁদে কেঁদে সে ঘুরপাক খাচ্ছিল। কিন্তু কিশোরী রতনের আশা কুল হারিয়েছিল। কারণ- তখন পোস্টমাস্টার নদীর কুল থেকে নৌকায় উঠে ঘরে ফিরছিল।
গল্পের শেষে দেখা যায়, পোস্টমাস্টার ও রতনের মধ্যে একই সময়ে পরস্পরবিরোধী ভাব-তত্ত্বের উদয় হয়েছিল। একদিকে নদীর উজানে রতন পোস্ট অফিসের চারপাশ ঘুরে ঘুরে অশ্রু বিসর্জন করছিল অন্যদিকে পোস্টমাস্টার বিপরীত স্রোতে বর্ষাবিস্ফোরিত নদীর পানিতে নৌকায় পাল তুলে ঘরে ফিরছিল।
নৌকা যখন গ্রামের শেষপ্রান্তের নদীর পাশের শ্মশানঘাট অতিক্রম করছিল তখন পোস্টমাস্টারের মনে একটি ভাবের উদয় হয়েছিল। সেটি হলো- জীবনে কত বিচ্ছেদ, কত মৃত্যু আছে, ফিরে ফল কী! এ পৃথিবীতে কে কার! পোস্টমাস্টারের এই ভাবের কিনারায় তরুনী রতনের হাহাকার ধ্বনি পৌঁছাইনি।
রবীন্দ্রনাথ এ গল্পের শেষে কিশোরী রতনের আবেগকে বর্ণনা দেন এভাবে- ‘হায় বুদ্ধিহীন মানবহৃদয়! ভ্রান্তি কিছুতেই ঘোচে না, যুক্তিশাস্ত্রের বিধান বহুবিলম্বে মাথায় প্রবেশ করে, প্রবল প্রমাণকেও অবিশ্বাস করিয়া মিথ্যা আশাকে দুই বাহুপাশে বাঁধিয়া বুকের ভিতরে প্রাণপণে জড়াইয়া ধরা যায়, অবশেষে একদিন সমস্ত নাড়ী কাটিয়া হৃদয়ের রক্ত শুষিয়া সে পলায়ন করে, তখন চেতনা হয় এবং দ্বিতীয় ভ্রান্তিপাশে পড়িবার জন্য চিত্ত ব্যাকুল হইয়া উঠে।’
বাস্তবিকই! আমরা একবার ভ্রান্তিতে পড়ে আবার উঠে দাঁড়াই এই বলে যে, প্রিয় মানুষটা ভুল শুধরে নিবে। তাকে আঁকড়ে ধরি। কিন্তু যার অন্তরটা একবার দোদুল্যমনতায় পড়েছে সে কি ফিরে আসে ভুল পথ থেকে! হয়তো আসে, হয়তো না। মানবজীবন ভ্রান্তিতে ভরা। সে কাছের জনকে দূরে ঠেলে প্রাণপণে চেষ্টা করে দূরের জনকে কাছে আনতে। এই ভ্রান্তিতে ভরা মানুষের জীবনকে তাই বইয়ে বেড়াতে হয় অন্তহীন দুঃখ, কষ্ট, ঘৃণা ও অভিমান ভরা নিদারূপ শোক-পরিতাপ। এর নিস্তার নেই।
অনাথিনী রতনের মনে প্রেমঘটিত কোন কারণ গল্পে উল্লেখ নেই। তবে পোস্টমাস্টারের কথা, কাজ ও আচরণ কিশোরীর কাছে বড় বলে মনে হয়েছিল। যার কাজ আপনার মনে বিস্ময় জাগায় তার জন্য আপনার আকুতি থাকতেই পারে। সে আকুতির জাগতিক মূর্তি হলো প্রেম। প্রেম বা ভালোবাসা শ্রদ্ধারই অন্যনাম। শুধুমাত্র ‘মোহ’ ভালোবাসা হতে পারে না।
আপনি জগতে যদি কাউকে হারানোর আশংকা করেন তবে সেটা হবে প্রেমের আশংকা! যে হারানোর আশংকায় আপনার হৃদয় ব্যাকুল ব্যথায় কাতর হয় সেটা হচ্ছে প্রেমমগ্নতা। যে সম্পর্কে আচ্ছন্ন হয়ে মানুষ নিজেকে খেলো করেন তা মোহাচ্ছন্নতা। মোহ কেটে যায়। বেলা ফুরাবার আগে মোহ একসময় ‘বাতাসে দোল খেয়ে যায় ঈঙ্গিতে’ এর মতো হারিয়ে যায়। প্রেম জ্বাজল্যমান থাকে। সম্পর্ক যখন বছরের পর বছর ঠিকে যায় তাতে মোহচ্ছন্নতা থাকে না। তাতে প্রধান্য পায় ইচ্ছের প্রণিপাত!
তারাশঙ্করের ‘কবি’ উপন্যাসের নায়ক নিতাইচরণ একসময় ঝুমুর দলের গায়িকা বসন্তকে ভালোবাসে। বসন্ত একসময় মারা যায়। নিতাইয়ের মন মানে না। নিতাই সারারাত শ্মশানে বসে বসন্তের ফেরার অপেক্ষায় থাকে! নিতাই ভাবে, দেহের মমতায় বসন্তের আত্মা ফিরে আসবে। মনে মনে নিতাই বলতেছিল, বসন এস!…বসন এস! বসন এস! কিন্তু বসন্ত আসেনি।
বসন্তের মাঝে নিতাই জীবনের অর্থ খুঁজে পেয়েছিল। নিতাইয়ের কাছে এ প্রেম ছিল শুধু আবেগ বা শ্রদ্ধার স্বার্থে নয়, পুরো জীবনের স্বার্থে। এ জন্যেই নিতাইদের প্রেম চিরায়ু।
আপনার মতামত লিখুন :