মুরুং বাহিনীর অতীত ও বর্তমান


Momtaj Uddin Ahamad প্রকাশের সময় : মে ২৮, ২০২৩, ১১:৫৩ পূর্বাহ্ন /
মুরুং বাহিনীর অতীত ও বর্তমান

-মমতাজ উদ্দিন আহমদ

প্রাককথন:

বান্দরবান পার্বত্য জেলার লামা-আলীকদমের ‘মুরুং বাহিনী’ নাম ভুলতে বসেছে অনেকে। স্বাধীনতা পরবর্তী আশির দশকের গৌরবময় এ বাহিনীর নাম পার্বত্য চট্টগ্রামে এখন অশ্রুত। অথচ এ বাহিনীর সশস্ত্র প্রতিরোধের মুখে লামা-আলীকদমের পাহাড় থেকে শান্তিবাহিনীর সন্ত্রাসীরা পলায়ন করতে বাধ্য হয়েছিল। আশির দশকে এ দু’উপজেলায় সেনা বাহিনীর সাথে কাধে কাধ মিলিয়ে সন্ত্রাস প্রতিরোধে ভূমিকা রাখে মুরুং বাহিনী।

মাঝে মধ্যে প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের বক্তৃতায় মুরুং বাহিনীর গৌরবময় অবদানের উচ্চারণ শোনা গেলেও এ বাহিনীর উন্নয়নে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। আলীকদমে মুরুং বাহিনীর অবিসংবাদিত নেতা বাবু মেনলে মুরুং দুরারোগ্যে রোগের করালগ্রাসে পতিত হয়ে দিনের পর দিন কষ্ট পেয়ে মারা গেলেও জীবদ্দশায় তাঁর খোঁজ নেয়নি কেউ।

যে মেনলে মুরুং আশির দশকে মুরুং বাহিনী প্রতিষ্ঠা করে শান্তি বাহিনীর সন্ত্রাস প্রতিরোধে বীরবিক্রমে যুদ্ধ করে নিজের একটি পা হারান; তার অন্তিমকালে আমরা তাঁর যথোপযুক্ত সমাদর দিতে পারেনি।

শান্তিবাহিনী গঠন

দেশ স্বাধীনের পর পার্বত্য চট্টগ্রামের কিছু শিক্ষিত ও উচ্চ বিলাসী উপজাতীয় নেতৃবৃন্দ পার্বত্য চট্টগ্রামকে আলাদা অঞ্চল ঘোষণা করে নিজস্ব আইন পরিষদের অধীনে শাসন ও পরিচালনার জন্য স্বায়ত্ব শাসনের দাবীতে তৎপর হয়ে উঠেন। এ ধারাবাহিকতায় তাঁরা ১৫ ফেব্রুয়ারী ১৯৭২ ইং তারিখে তাঁদের কতিপয় দাবী-দাওয়া নিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে সাক্ষাত করেন। এ সময় উপজাতীয় নেতারা পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলকে নিজস্ব আইন পরিষদের অধিনে পরিচালনা ও সংবিধানে তা অন্তর্ভূক্তির দাবী জানান।

একটি সদ্য স্বাধীন দেশে আলাদা একটি জাতি অঞ্চল গঠন ও পৃথক শাসনবিধি পরিকল্পনা বঙ্গবন্ধু কর্তৃক প্রত্যাখাত হয়। তৎসময়ের উপজাতীয় নেতৃবৃন্দ বিয়ষটিকে সহজভাবে মেনে নিতে পারেননি।

ফলে সাড়ে পাঁচ মাসের মাথায় অর্থাৎ ২৪ জুন ১৯৭২ সালে গঠিত হয় ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি’। যা সংক্ষেপে ‘জেএসএস‘ বলে পরিচিত। পরবর্তী ৬ মাস পর গঠিত হয়ে জেএসএস এর সশস্ত্র শাখা “শান্তি বাহিনী”।

এক সময় লামা-আলীকদম শান্তি বাহিনীর অভয়ারণ্য ছিল। তাদের অত্যাচার-নির্যাতন-নিপীড়ন, হত্যা-লুণ্ঠন ও চাঁদাবাজিতে এতদাঞ্চলের পাহাড়ি-বাঙ্গালীরা ভীত-সন্ত্রস্ত থাকত। রাতে শান্তিবাহিনীর ভয়ে লোকজন বাসা বাড়ীতে থাকতে পারতো না। শান্তি বাহিনী শুধু বাঙ্গালীদেরকেই নয় মুরুংদেরও নানাভাবে অত্যাচারিত নির্যাতিত এবং ধর্ষণ ও চাঁদাবাজির শিকার হতে হতো। শান্তিবাহিনীর দাবী পূরণ করতে না পারলে মুরুংদেরকে জীবন দিতে হতো।

মুরুংদের প্রথম আক্রমণের মুখে শান্তিবাহিনী

১৯৮৫ সাল। আলীকদমের মাতামুহুরী রিজার্ভের কচ্ছইপ্যা মুখের লোংরা পাড়ার ঝিন ঝিরিতে শান্তি বাহিনীর একটি আস্তানা ছিলো। এই আস্তানায় একদিন রাতের দ্বিপ্রহরে আধাঁরে মেনলে মুরুং এর নেতৃত্বে একটি দল দা, কুড়াল, লাঠিসোটা ও গাদা বন্দুক নিয়ে অতর্কিত আক্রমণ চালানো হয়। গাদা বন্দুকের একটি আওয়াজে শান্তিবাহিনীর সদস্যরা ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে জেগে উঠে যে যার মতো করে দেয় দৌড়।

বিনা বাধায় মেনলে মুরুং এর দল ঐ আস্তানাটির দলয়ে নেয়। সেখান থেকে ১টি রাইফেল, ২টি এস এল আর, ১টি এল এম জি ও ৭৫০টি গুলি। মুরুং বাহিনীর প্রথম আক্রমণে প্রাথমিক অস্ত্র ভান্ডার গড়ে উঠে। এ আক্রমণে অস্ত্র ছাড়াও প্রায় ৫/৬ মন চাউল পেয়েছিলো মুরুংরা। প্রথম প্রতিরোধ আক্রমণের এই সাফল্য দেখে মুরুং বাহিনীর সদস্য সংখ্যাও দিন দিন বাড়তে থাকলো।

মুরুং বাহিনী গঠন প্রক্রিয়া

এই আক্রমণের ধারাবাহিকতায় মুরুংরা নিজেদের নিরাপত্তা ও মা-বোনদের সম্ভ্রম রক্ষার্থে একতাবদ্ধ হয়ে শান্তি বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। মুরুংদের এই সাহসিকতা দেখে এঁদের পাশে এসে দাড়ায় বাংলাদেশ সেনা বাহিনী, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসন। এঁদের সহায়তায় স্বেচ্ছাসেবক দল হিসেবে বিগত ১৯৮৫ সালে (১৪ সেপ্টেম্বর?) আলীকদম সদরে বেসরকারী স্বেচ্ছাসেবক দল হিসেবে ‘মুরুং বাহিনী’ গঠিত হয়। তাঁদের প্রথম পোষাক ছিল “লাল” রং এর। স্থানীয়রা তাঁদেরকে ‘লাল বাহিনী’ কিংবা ‘গরম বাহিনী’ হিসেবে ডাকতো।

যাঁদের নেতৃত্বে মুরুং বাহিনীর সংগঠিত হয়

মুরুং বাহিনী গঠন প্রক্রিয়ার সাথে আলীকদম ও লামায় প্রথমে যাঁরা নেতৃত্বে ছিলেন তাদের মধ্যে যথাক্রমে দুক্কা মুরুং, মেননাও মুরুং, আনাচরণ ত্রিপুরা, পাখি মগ, রেনক্রি মুরুং, মেনলে মুরুং, প্রেনএ মুরুং, হমকাম মুরুং, মেনরাই মুরুং, পারাও মুরুং (বলি), রেংচু মুরুং, বোলাই মুরুং, লাংগি কমান্ডার, রাংক্লাং মুরুং, তংলক মুরুং মেম্বার, চমবট মুরুং, সেক্সে মুরুং ও মাংরূম মুরুং প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। আরো অনেকে স্ব-স্ব ক্ষেত্রে এ বাহিনী গঠন ও তাদের কর্ম পরিকল্পনা নির্ধারণে সহযোগিতা করেন। 

মুরুং বাহিনী গঠনোত্তর এ বাহিনীর সদস্যরা সরকার স্বীকৃত আনসার-ভিডিপিতে স্বেচ্ছায় যোগ দিয়ে এলাকার জনগণের জান-মালের নিরাপত্তাসহ নিজেদের ও অন্যদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে তোলে।

মুরুং বাহিনী গঠনের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যসমুহ

ক. দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় বসবাসরত উপজাতিদের নিরাপত্তা দান।

খ. এলাকার শান্তি-শৃঙ্খলার রক্ষার্থে সেনা বাহিনী, বিডিআর, পুলিশ ও আনসার-ভিডিপিদের সহায়তা প্রদান।

গ. সরকারী বেসরকারী সুবিধাবঞ্চিত দুর্গম পাহাড়ি এলাকার পশ্চাৎপদ মুরুং উপজাতীয়দের শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সার্বিক উন্নয়নে সেনা বাহিনী ও স্থানীয় প্রশাসনের সাথে সমন্বয় সাধন ও দাবী-দাওয়া আদায়।

ঘ. পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন।

ঙ. স্থানীয় উপজাতি ও বাঙ্গালীদের মধ্যে সহাবস্থান, ভ্রাতৃত্ববোধ ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের পরিবেশ উন্নত করা।

চ. এলাকার সন্ত্রাসী, দুষ্কৃতিকারী, চাঁদাবাজদেরকে দমনে সেনা বাহিনীকে সহায়তা করা।

ছ. সরকার প্রদত্ত মৌলিক সুযোগ-সুবিধা ও বিভিন্ন পরিসেবাগুলি তৃণমূল পর্যায়ের উপজাতীয়দের নিকট পৌঁছাতে সহায়ক ভূমিকা পালন করা।

জ. ১৯৭৬ সাল পরবর্তী লামা-আলীকদমের বিপদগামী উপজাতীয়দেরকে সুস্থ-স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে এনে তাদের আত্মকর্মসংস্থান, আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন, পুনর্বাসন ও সার্বিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখা।

ঝ. স্থানীয় পাহাড়ি-বাঙ্গালীদের মধ্যে মৈত্রীর সম্পর্ক স্থাপনে সহায়তা করা।

ঞ. লামা-আলীকদমে পৃথক দু’টি মুরুং কমপ্লেক্স স্থাপন করে মুরুং উপজাতি ছেলে-মেয়েদের পড়ালেখা ও সার্বিক উন্নয়নে অবদান রাখা।

ট. প্রতিবছর লামা ও আলীকদম উপজেলায় সেনা বাহিনীর সহায়তায় পৃথক দু’টি বার্ষিক সম্মেলন (মুরুং সম্মেলন) এর মাধ্যমে তাদের কর্মকা-ের সফলতা-ব্যর্থতা নিরূপন করে ভবিষ্যত কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের রূপরেখা তৈরী করা।

উল্লেখিত উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য বাস্তবায়নের সুফল হিসেবে ১৯৮৬ সাল থেকে লামা ও আলীকদম উপজেলাকে শান্তি বাহিনী মুক্ত ঘোষণা করেন তৎকালীন ৩য় বেঙ্গল এর অধিনায়ক লে.কর্ণেল শাহ জাহান মিয়া।

তাঁর সহায়ক হিসেবে ছিলেন ৩য় বেঙ্গলের উপ অধিনায়ক বর্তমান অবসরপ্রাপ্ত লে.জেনারেল আ:ত:ম: জহিরুল আলম পিএসসি, এনডিসি ও তৎকালীন লামার সাব জোন কমান্ডার বর্তমান অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এসএম গোলাম রব্বানীসহ তৎসময়ের অত্র লামা-আলীকদম উপজেলায় কর্মরত সেনা বাহিনীর কর্মকর্তা ও সৈনিকবৃন্দ।

মুরুং বাহিনী গঠনে আরো যাঁরা অবদান রেখেছেন

মুরুং বাহিনী গঠনে উপরোক্ত সেনা অফিসারদের পাশাপাশি আরো যাঁরা অবদান রেখেছেন তাঁদের মধ্যে সাবেক লামা উপজেলা চেয়ারম্যান মরহুম আলহাজ্ব আলী মিয়া, সাবেক আলীকদম উপজেলা চেয়ারম্যান আবু জাফর বিএ,বি-এড, তৎকালীন আলীকদম সদর ইউ.পি চেয়ারম্যান আলহাজ্ব আলীমুদ্দিন, মরহুম খুইল্যা মিয়া, আলহাজ্ব গুরা মিয়া, লামার সাবেক ইউ.পি চেয়ারম্যান মরহুম আব্দুল মালেক চৌধুরী, সাংবাদিক রুহুল আমিন, ২নং চৈক্ষ্যং ইউ.পির সাবেক চেয়ারম্যান মরহুম আহমদ কবির, গজালিয়ার সাবেক ইউ.পি চেয়ারম্যান ম্রাথোয়াই অং চৌধুরী, লামার ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান মরহুম আমির হোসেন মজুমদার ও লামার সরই ইউ.পি’র সাবেক সদস্য তংলক মুরুং মেম্বার প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য।

পাশাপাশি মুরুং বাহিনী গঠনে স্থানীয় মার্মা উপজাতিদের মধ্যে ২৮৮নং আলীকদম মৌজার হেডম্যান প্রয়াত থোয়াইউগ্য মার্মা, ২৯২নং চাইম্প্রা মৌজার হেডম্যান চাথুইপ্রু মার্মা, ২৮৭নং তৈন মৌজার হেডম্যান হ্লাঅং মার্মা ও ২৮৯নং চৈক্ষ্যং মৌজার হেডম্যান প্রয়াত মংবাচিং মার্মা প্রমুখের অবদান স্মরণীয়।

মুরুং বাহিনীকে দমিয়ে রাখতে প্রতিরোধ

মুরুং বাহিনী গঠন হওয়ার পর শান্তিবাহিনীর পক্ষ থেকে মুরুং নিধনের জন্য ব্যাপকভিত্তিক প্রতিরোধ গড়ে তোলা হয়। ফলে রাতে দিনে বিভিন্ন পাড়া মহল্লায় শান্তি বাহিনী মুরুং পল্লীতে হানা দিতে থাকে। তখন মুরুং বাহিনীর সদস্যরা নিজেদের পাড়ায় বাংকার সৃষ্টি ও চলাচল পথে বিশেষ পদ্ধতিতে ‘বাঁশকল’ নামে এক ধরণের ফাঁদ তৈরী করতো। ফলে বাঁশকলের ভয়ে পাহাড়ি এলাকায় রাস্তা দিয়ে সহজভাবে শান্তি বাহিনীর সদস্যরা ভীত-সন্ত্রস্ত থাকতো।

মুরুং বাহিনী গঠনোত্তর কর্মতৎপরতা

মুরুং বাহিনীর সদস্যরা ১৯৮৫ সাল পরবর্তীতে সেনা বাহিনীর সহায়তায় লামা-আলীকদমে উপজাতিদের শিক্ষা, চিকিৎসা, সংস্কৃতি, ধর্মীয় উৎসব, জুম চাষের পরিবর্তে ফলের বাগান, রাস্তা-ঘাট উন্নয়ন ও সংস্কারে ব্যাপক অবদান রাখে।

মুরুং সমাজের দরিদ্র ছেলে মেয়েদের বিবাহের খরচ যোগাতে সেনা বাহিনী প্রদত্ত আর্থিক সাহায্য পৌঁছাতো মুরুং বাহিনীর সদস্যরা। স্থানীয় প্রশাসনের সহায়ক শক্তি হিসেবে নানান সমাজ সেবামূলক কাজে মুরুং বাহিনীর সম্পৃক্ততা দেখে দিন দিন এ বাহিনীর সুনাম সর্বমহলে ছড়িয়ে পড়ে। এ বাহিনীকে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর আশির্বাদ হিসেবে স্থানীয়রা মনে করতে থাকে।

যেখানে তথাকথিত শান্তি বাহিনীর ভয়বহ তান্ডব ও লুণ্ঠনযজ্ঞ চলছিল সেখানে মুরুং বাহিনী অমিত বীরবিক্রমে শান্তি বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলে সাহসী ভূমিকা পালন করেন। ফলে আশির দশকে পার্বত্য চট্টগ্রামে যেখানে শান্তি বাহিনী কর্তৃক সৃষ্ট তান্ডবে অশান্তির আগুন জ্বলছিল সেখানে ১৯৮৪-৮৫ সালে সেনা বাহিনীর পক্ষ থেকে লামা-আলীকদমকে শান্তি বাহিনী ও সন্ত্রাসমুক্ত ‘শান্তির জনপদ’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছিল।

আলীকদম জোন ও মুরুং বাহিনীর প্রচেষ্টায় স্থানীয়রা লামা উপজেলার তাও পাড়ায় একটি বেসরকারী রেজিস্ট্রার্ড প্রাথমিক বিদ্যালয়, গজালিয়া জুনিয়র হাইস্কুল (বর্তমানে- হাইস্কুল), ফাঁসিয়াখালী জুনিয়র হাইস্কুল (বর্তমানে- হাইস্কুল), রূপসী পাড়া হাইস্কুল এবং আলীকদম উপজেলায় রেপারপাড়ী আবাসিক বিদ্যালয়, চৈক্ষ্যং মৈত্রী বেসরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়, আলীকদম আদর্শ সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় মৈত্রী উপজাতীয় আবাসিক, কুরুকপাতা মৈত্রী  প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ প্রভৃতি বিদ্যালয় স্থাপন করা হয়েছিল।

বর্তমানে এসব বিদ্যালয় কিছুটা নাম পরিবর্তন হলেও আশি এবং নব্বয়ের দশকে আলীকদম সেনা জোনের অমর কীর্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠানগুলোতে একাডেমিক কার্যক্রম চালু রয়েছে।

১৯৯৭ সালের ২রা ডিসেম্বর বাংলাদেশ সরকারের সাথে শান্তিবাহিনীর রাজনৈতিক সংগঠন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির মধ্যে সম্পাদিত ‘শান্তি চুক্তি’র ফলে সংগত কারণে মুরুং বাহিনীর কার্যক্রমে ভাটা পড়ে। ফলে এরপর থেকে মুরুং বাহিনীর কর্মতৎপরতা কমতে শুরু করে।

মুরুং বাহিনীর বর্তমান অবস্থা

মুরুং বাহিনীর হারানো ঐতিহ্য ও জৌলুস এখন তেমন একটা চোখে পড়ে না। তারপরেও কতিপয় উদ্যমী, ত্যাগী ও দেশপ্রেমিক মুরুং যুবকরা মুরুং বাহিনীর নামটি বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করতে সদা তৎপর। কিন্তু অবহেলা, উদাসীনতা, সরকারী পৃষ্ঠপোষকতা ও বঞ্চনার কারণে এখনকার মুরুং বাহিনী তেমন সুসংগঠিত নয়।

আলীকদমে মুরুং বাহিনীতে ৬২ জন সদস্য থাকলেও লামা উপজেলায় মুরুং বাহিনীর কার্যক্রম নেই। ইতোপূর্বে নিয়ম করে প্রতিবছর মুরুং সম্মেলন হলেও এখন তেমন হয় না।

আলীকদম মুরুং বাহিনর কমান্ডার বাবু মেনদন বলেন, একসময় মুরুং বাহিনীকে ধ্বংস করতে আলীকদমে পার্বত্য চট্টগ্রামের একটি আঞ্চলিক উপজাতীয় রাজনৈতিক সংগঠন তৎপর ছিল। এখন একটু কম। ৬২ জন সদস্য এখন মুরুং বাহিনীতে রয়েছে। তবে তাদেরকে বিপদগামী করতে স্বার্থান্বেষী মহল সবসময় তৎপর থাকে।

বর্তমানে লামায় সংগঠিত কোন মুরুং বাহিনী নেই। ফলে ‘লামা মুরুং কমপ্লেক্স’টি পূর্বের ন্যায় স্থানীয় মুরুং সমাজের উন্নয়নে কর্মতৎপরতা চালাতে পারেছনা। এক্ষেত্রে মুরুং বাহিনীর প্রতি বঞ্চনার চিত্রও ফুটে উঠে। মুরুং বাহিনীর প্রতি বঞ্চনা অব্যাহত থাকলে হয়ত এক সময় এ বাহিনীর অতীত অবদান পরবর্তী প্রজন্ম জানতে পারবে না।

মুরুং বাহিনীর অবদান স্বীকার

আলীকদম জোন সদরে অনুষ্ঠিত এক মুরুং সমাবেশে বান্দরবান রিজিয়নের সাবেক কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবুল কালাম মোহাম্মদ হুমায়ূন কবির, পিএসসি বলেছিলেন, পার্বত্যাঞ্চলের সন্ত্রাস নির্মূলে মুরুং বাহিনীর অবদান অনস্বীকার্য। মুরুং বাহিনীর সদস্যরা রক্ত দিয়ে সেনা বাহিনীর পাশে থেকেছেন। তাই মুরুং সম্প্রদায় সেনা বাহিনীর অকৃত্রিম বন্ধু। মুরুং বাহিনীকে পুনরুজ্জীবিত করে তাদের আত্মসামাজিক উন্নয়নে সর্বোতভাবে সহযোগিতা করা হবে। তিনি বলেন, শিক্ষার উন্নয়নে মুরুংদের প্রচেষ্টাকে অর্থনৈতিক ও অবকাঠামোগত সকল সুবিধা প্রদান করা হবে।

একই অনুষ্ঠানে আলীকদম জোনের সাবেক জোন কমান্ডার লেঃ কর্ণেল আজিম উল্লাহ বাহার পিএসসি বলেছিলেন, মুরুং বাহিনী পার্বত্যাঞ্চলের সন্ত্রাস নির্মূলে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রেখেছেন। বিশিষ্ট মুরুং নেতা মেনলে মুরুং এর প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াই করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।

মুরুং সমাজের উন্নয়নে যা করা প্রয়োজন

পাহাড়ি উপজাতিদের মধ্যে সহজ, সরল জীবনে অভ্যস্ত এ সম্প্রদায় স্বাধীনতা পরবর্তী পার্বত্যাঞ্চলের ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধাবসানে সরকারের মিত্রশক্তি হিসেবে আভির্ভূত হয়েছিলো। বিশেষ করে বান্দরবানের লামা-আলীকদম উপজেলায় শান্তির সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টিতে তাদের সাহসী ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আজ একটি ম্রিয়মাণ প্রসঙ্গ। সদাশয় সরকার কর্র্তৃক মুরুংদের কল্যাণে নিন্মোক্ত কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করলে মুরুং সম্প্রদায়ের উন্নয়ন-অগ্রগতিতে সহায়ক হতে পারে।

ক. লামা-আলীকদম উপজেলায় সেনা জোনের তত্ত্বাবধানে সুবিধা বঞ্চিত মুরুং ছেলে মেয়েদের আবাসিক সুবিধাসহ শিক্ষাবৃত্তি প্রদান করা।

খ. উচ্চশিক্ষায় আগ্রহী মুরুং ছেলে মেয়েদের সরকারী সহায়তা বৃদ্ধি করা।

গ. বেকার ও দরিদ্র মুরুং যুবক-যুবতিদের আত্মকর্মসংস্থানের জন্য পরিবেশবান্ধব বাগান ও বনায়ন সৃষ্টিতে সহায়তা প্রদান করা।

ঘ. প্রতিটি মুরুং পল্লীতে সরকারী ব্যবস্থাপনায় স্কুল প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে শিক্ষা কর্মসূচী পালন করা।

ঙ. মুরুংদের দারিদ্রতা বিমোচনের জন্য একটি পঞ্চবার্ষিকী কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা।

চ. মুরুংদের নিজস্ব ভাষা, বর্ণমালা ও সংস্কৃতিকে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষায় সরকারীভাবে আলাদা একটি মুরুং সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট গঠন করা।

ছ. লামা-আলীকদমে সরকারীভাবে পৃথক দু’টি মুরুং ছাত্রাবাস ও আবাসিক বিদ্যালয় গঠন করা।

জ. মুরুংদের শিক্ষা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য রক্ষায় সরকারীভাবে আলাদা একটি ‘মুরুং কল্যাণ ট্রাস্ট’ গঠন করা।

ঝ. মুরুং ভাষা ও বর্ণমালায় সরকারীভাবে পাঠ্যপুস্তক তৈরী করে শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করা।

ঞ. মুরুংদের জন্য আলাদা একটি ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্ট গঠন করে মুরুং ধর্মকে মিশনারীদের ধর্মীয় আগ্রাসন থেকে রক্ষা করা।

ট. মুরুং নারীদের কল্যাণে বৃত্তিমূলক তাঁত প্রশিক্ষণ গ্রহণসহ শিশু ও মাতৃস্বাস্থ্য রক্ষায় পৃথক একটি কর্মসূচী চালু করা।

বর্তমান সরকার দেশের জলবায়ু পরিবর্তন, পরিবেশ বিপর্যয় রোধ ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের জন্য দেশী-বিদেশী সংস্থার অর্থায়নে ব্যাপক কর্মসূচী গ্রহণ করেছে। মুরুং সম্প্রদায়ের বসবাস গভীর অরণ্যে ও পাহাড়ে বিধায় তাদেরকে উক্ত কর্মসূচীর আওতায় এনে বনায়ন, ফলজ বাগান, বাঁশ বাগান, মৎস্য চাষ ও গবাদি পশু পালনসহ পরিবেশবান্ধব কাজে তাদেরকে নিয়োজিত করা হলে দেশের পরিবেশ উন্নয়নের পাশাপাশি নিজেদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে অবদান রাখতে পারে। এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সরকার ও প্রশাসন মুরুং বাহিনীকে কাজে লাগাতে পারে। এতে প্রাথমিকভাবে তাদের দারিদ্রতা বিমোচন ও চলমান অভাব-অনটন দুরিভুত করা সম্ভব।