বিপর্যয় মানুষের কৃতকর্মের ফল


Momtaj Uddin Ahamad প্রকাশের সময় : জুন ২৫, ২০২৪, ১১:৪৭ পূর্বাহ্ন /
বিপর্যয় মানুষের কৃতকর্মের ফল

।। মমতাজ উদ্দিন আহমদ ।।

মহাগ্রন্থ আল কুরআনের সূরা রুমের ৪১নং আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘জলে-স্থলে বিপর্যয় মানুষের কৃতকর্মের ফল। যার ফলে আল্লাহ তাদের কতিপয় কৃতকর্মের স্বাদ তাদেরকে আস্বাদন করান, যাতে তারা ফিরে আসে।’

কুরআনে বর্ণিত শব্দ বাররি অর্থ স্থল। এখানে ‘স্থল’ বলতে মানুষের বাসভূমি বুঝানো হয়েছে। বাহরি অর্থ জল। শব্দটি সমুদ্র, সামুদ্রিক পথ এবং সমুদ্র-উপকূলে বসবাসের স্থান বুঝানো হয়েছে। ‘ফাসাদ’ অর্থ বিপর্যয়। যে সকল কারণে মানুষের সুখ-শান্তি ও নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয় তাকে ফাসাদ বলা হয়েছে।

কুরআনের এই আয়াতের ব্যাখ্যা তাফসিরবিদেরা নানান উদাহারণ ও  উপমায় করেছেন। তবে এর সহজ ব‌্যাখ‌্যা হলো বান্দা যদি আল্লাহর হুকুমের অবাধ‌্য হয় তিনি সতর্ক করেন। এর উদাহরণ আছে কুরআনে।

যেমন: অতীতে আল্লাহ অনেক শক্তিশালী জাতীকে ধ্বংস করেছিলেন। নবী হুদ (আ.) কর্তৃক বারবার সতর্ক করার পরও ‘আদ জাতি’ আল্লাহর হুকুম মানেনি। ফলে ‘আদ জাতী’র এলাকায় প্রথম তিন বছর বৃষ্টি বর্ষণ বন্ধ ছিল। ফসল উৎপাদন ব‌্যাহত হয়। ওরা সতর্ক হয়নি। ফলে সাত দিন আট রাতের বজ্র ঝড়ে ‘আদ জাতী’র সবাই মারা যায়। ‘সামুদ জাতি’-ও ছিল আল্লাহর অবাধ‌্য। তারা হযরত সালেহ (আ.)-এর সতর্কবার্তা মানেনি। বরং নবীকে হত‌্যার সিদ্ধান্ত নেয়। ওরা আল্লাহর কুদরতি উটকে হত্যা করেছিল। ফলে আল্লাহ পাক প্রস্তর বর্ষণে ও বজ্রপাতের মাধ্যমে তাদের ধ্বংস করেন।

এ আয়াতে বর্ণিত ‘ফাসাদ’-এর অর্থ আকাশ-পৃথিবীর ঐ সকল বিপর্যয়কে বলা যায়, যা আল্লাহর পক্ষ থেকে শাস্তি ও সতর্কতা স্বরূপ প্রেরণ করা হয়। মহামারী, ঝড়ো-বাতাস, জলোচ্ছ্বাস, ভূমিকম্প, বন্যা ইত্যাদি। যখন মানুষ আল্লাহর এই ফাসাদের অর্থ ভুলে তার অবাধ্যতাকে নিজেদের অভ্যাসে পরিণত করে নেয়, তখন আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রতিফল স্বরূপ তাদের কর্মপ্রবণতা মন্দের দিকে ফিরে যায় এবং তার ফলে পৃথিবী নানা বিপর্যয়ে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে, সুখ-শান্তি বিলীন হয়।

মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন কত সুন্দর করেই না এই পৃথিবী সাজিয়েছেন। জাতীয় কাজী নজরুল ইসলামের নিচের গানটিতে আল্লাহর প্রদত্ত নিয়ামতরাজি ও মানুষের অবাধ‌্যতা স্বত্বেও স্রষ্টা কিভাবে মানুষকে খাদ‌্য-পানি যোগান তা তুলে ধরেছেন অতি চমৎকারভাবে। কবি বলেছেন-

‘এই সুন্দর ফুল সুন্দর ফল মিঠা নদীর পানি / খোদা তোমার মেহেরবানি॥ শস্যশ্যামল ফসলভরা / মাঠের ডালিখানি / খোদা তোমার মেহেরবানি॥ … খোদা! তোমার হুকুম তরক করি আমি প্রতি পায়, / তবু আলো দিয়ে বাতাস দিয়ে বাঁচাও এ বান্দায়।

মানুষকে সৃষ্টির আগেই সাজানো ছিল পৃথিবী। এ জগৎ সংসারকে পুর্ণতা দিতে তিনি পাহাড়, নদী, খাল, বিল, মরুভূমি, মালভূমি, গাছপালা, উদ্ভিদ তৃণলতা প্রভৃতি সৃষ্টি করলে। আগুন, পানি, বাতাস, মাটিসহ মৌলিক চার উপাদানকে তিনি প্রকৃতির আওতায় সৃজন করলেন। হরেক রকমের পশু–পাখি, জীব, জড়, প্রাণী দিয়ে তিনি পুরো পৃথিবীর আনাচ-কানাচ পূর্ণ করলেন।

বিশ্বপ্রকৃতি সৃষ্টি সম্পর্কে সুরা রা’দের ৩ নাম্বার আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘তিনিই জমিনকে বিস্তৃত করেছেন এবং এর মধ্যে পর্বত ও নদী সৃষ্টি করেছেন। আর তিনি প্রত্যেক ফল সৃষ্টি করেছেন দুই ধরনের। তিনি দিবসকে রাত্রি দ্বারা আচ্ছাদিত করেন। এতে অবশ্যই চিন্তাশীলদের জন্য নিদর্শন রয়েছে।’ (সুরা রাদ : ০৩)।

আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশে প্রায় সময় দুর্যোগ আসে প্রাকৃতিক নিয়মে। এই প্রকৃতি মহান স্রষ্টার অধীন। স্রষ্টার হুকুম ছাড়া সৃষ্টির একটি পাতাও নড়ে না। গোটা প্রকৃতি মহান আল্লাহর সৃষ্টি। তার কর্তৃক পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত।

আমরা খোদার সৃষ্টির ওপর খোদকারী করছি নানানভাবে। উন্নয়নের নামে ধ্বংস করে চলেছি প্রকৃতির স্বাভাবিক কাঠামো। বিশ্বের  প্রযুক্তিগত উন্নত দেশগুলি যেখানে প্রযুক্তিনির্ভর রাস্তা-ঘাট তৈরী করছে সেখানে আমরা পার্বত‌্য চট্টগ্রামে পাহাড়ের পর পাহাড়ের গা কেটে রাস্তা বানাচ্ছি। ফলে ধ্বংস হচ্ছে পাহাড়ের স্বাভাবিক কাঠামো। অনিয়ন্ত্রিত পাহাড় কাটার মাটি পড়ছে পাহাড়ি ঝিরি, খাল, নদীর বুকে। ফলে দিন দিন নাব‌্যতা হারাচ্ছে মাতামুহুরী নদীসহ বিভিন্ন নদ-নদীর। আগামী ২০ বছর পর এসব নদী-খাল নাব‌্যতা হারিয়ে কি ভয়ংকর রূপ নেয় ভাবতেও অবাক লাগে।

আমাদের ভূ-প্রকৃতিতে পাহাড় স্থিরতার প্রতীক। অনিন্দ‌্যসুন্দর সবুজাভ সৌন্দর্যের আধার। আসমান ও জমিনে যা কিছু আছে তা পরিমিত ও সুবিন্যস্তভাবে সৃষ্টি করে ভারসাম্য রক্ষা করেছেন। তিনি জমিনকে বিছানা এবং পর্বতরাজিকে পেরেকস্বরূপ সৃষ্টি করেছেন যাতে জমিন এদিক-সেদিক সরে গিয়ে কোনো দুর্ঘটনা না ঘটে (সূরা নাবা : ৬-৭)।

বলা হয়ে থাকে আদি মানব হযরত আদম (আ.) বেহেশত থেকে সর্বপ্রথম এই পাহাড়েই নেমেছিলেন! ইতিহাসে এ পাহাড়ের নাম ‘আদম পাহাড়’ হিসেবে খ‌্যাত। এ পাহাড়ের চূড়ায় অক্ষয় হয়ে থাকা একটি পদচিহ্ন আল্লাহর কুদরত হিসেবে মুসলমানগণ মনে করেন। আল্লাহ বলেছেন, প্রকৃতিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সবই আল্লাহর কুদরতের নিদর্শন।

আকাশে অসংখ্য নক্ষত্র নিজ নিজ কক্ষে ঘুরছে। আল্লাহ সেখানেও ভারসাম্য স্থাপন করেছেন। যাতে মহাশূণ্যে কোনো সংঘাত সৃষ্টি না হয়ে শৃঙ্খলা বজায় থাকে। আকাশে সূর্য এবং ভূ-মণ্ডলে বরফের পাহাড় সৃষ্টি করে আল্লাহ ঠান্ডা ও গরমের মধ্যে ভারসাম্য স্থাপন করেছেন। বায়ুমণ্ডলও সুশৃঙ্খলভাবে সৃষ্টি করেছেন যাতে কোনো বিঘ্ন না ঘটে।

এই সুন্দর প্রকৃতি কেন বিরূপ রূপ ধারণ করে? ঘূর্ণিঝড়, কালবৈশাখী, শিলাবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, জলোচ্ছ্বাস, ভারি বর্ষণ, বন্যা, খরা, দাবানল, শৈত্যপ্রবাহ; দুর্ভিক্ষ, মহামারি, ভূমিকম্প, সুনামি প্রভৃতির আঘাতে আমরা জর্জরিত হই! মহান আল্লাহ বিভিন্ন সময়ে নানা প্রতিকূল পরিস্থিতি দিয়ে আমাদের পরীক্ষা করে থাকেন এবং দেখেন আমরা তার কতটুকু অনুগত।

সূরা মুলকের ২নং আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘যিনি সৃষ্টি করেছেন মৃত্যু ও জীবন, তোমাদের পরীক্ষা করার জন্য-কে তোমাদের মধ্যে কর্মে উত্তম? তিনি পরাক্রমশালী, ক্ষমাশীল।

ঘূর্ণিঝড় ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ আসার কারণ

(১) যখন কোনো জাতির মধ্যে প্রকাশ্যে অশ্লীলতা ছড়িয়ে পড়ে তখন মহামারি আকারে (নতুন-নতুন) প্লেগ রোগের প্রাদুর্ভাব হয়, যা আগের লোকদের মধ্যে কখনো দেখা যায়নি।

(২) যখন কোনো জাতি ওজন ও পরিমাপে কারচুপি করে তখন তাদের ওপর নেমে আসে দুর্ভিক্ষ, কঠিন বিপদ-মুসিবত।

(৩) আর যখন কোনো জাতি জাকাত আদায় করে না, তখন আসমান থেকে বৃষ্টি বর্ষণ বন্ধ করে দেওয়া হয়। যদি জমিনে চতুষ্পদ জন্তু ও নির্বাক প্রাণী না থাকত তবে আর কখনো বৃষ্টিপাত হতো না।

(৪) যখন কোনো জাতি আল্লাহ ও তার রাসূলের অঙ্গীকার ভঙ্গ করে, তখন আল্লাহ তাদের ওপর বিজাতীয় দুশমনকে ক্ষমতাসীন করে দেন। আর তারা (শাসকবর্গ মানুষের) সহায় সম্পদ কেড়ে নেয়।

(৫) আর যখন তোমাদের শাসকবর্গ আল্লাহর কিতাব মোতাবেক মীমাংসা না করে এবং আল্লাহর নাজিলকৃত বিধান গ্রহণ না করে, তখন আল্লাহ তাদের পরস্পরের মধ্যে যুদ্ধ লাগিয়ে দেন। (ইবনে মাজাহ)।

উল্লিখিত পবিত্র কুরআনের আয়াত ও হাদিসের দিকনির্দেশনা প্রমাণ করে যে, মানুষের গুনাহের কারণেই দুনিয়াতে বিভিন্ন রকম বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়ে। এ বিপর্যয় কখনো সমুদ্রে ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, জমিনে ঝড়-তুফান, অজানা মহামারি, রোগ-ব্যাধি, অন্যায়ভাবে যুদ্ধ-বিগ্রহ তৈরি করে দেয়।

প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বিপর্যয় ও প্রতিকূল অবস্থায় রাসূল (সা.) খুব বিচলিত হয়ে পড়তেন এবং আল্লাহর শাস্তির ভয় করতেন। এ সময় তিনি তওবা-ইস্তেগফার-নামাজে মশগুল হতেন ও তার সাহাবাদেরও বেশি বেশি তা করার নির্দেশ দিতেন। এ জন্য আমাদের এ আমলগুলোর প্রতি যত্নবান হতে হবে। বিশেষত অতীতের সব গোনাহ ও ভুলের জন্য আল্লাহর কাছে তওবা করে নিতে হবে। পাশাপাশি ঘূর্ণিঝড় ও প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকে রক্ষা পেতে রাসূল (সা.) কয়েকটি দোয়া শিখিয়েছেন।

জোরে বাতাস প্রবাহিত হলে দোয়া

‘আল্লাহুম্মা ইন্নি আসআলুকা খাইরাহা, ওয়া আউযুবিকা মিন শাররিহা’

অর্থ : হে আল্লাহ! আমি আপনার নিকট এর কল্যাণটাই কামনা করি। এবং আপনার কাছে এর অনিষ্ট থেকে আশ্রয় চাই। (আবু দাউদ ৪/৩২৬, হাদিস : ৫০৯৯)।

গর্জনের সময় দোয়া

‘সুবহানাল্লাজি ইউসাব্বিহুর রাদদু বিহামদিহি ওয়াল মালাইকাতু মিন খিফাতিহি’

অর্থ : পাক-পবিত্র সেই মহান সত্তা তার প্রশংসা পাঠ করে বজ্র এবং সব ফেরেশতা।

হজরত আবদুল্লাহ ইবন যুবাইর (রা.) যখন মেঘের গর্জন শুনতেন, তখন কথা বলা বন্ধ করে দিতেন এবং পবিত্র কুরআনের ওপরের এ আয়াতটি তেলাওয়াত করতেন।

ঝড়-বাতাসের অনিষ্ট থেকে সুরক্ষা পেতে দোয়া

‘আল্লাহুম্মা ইন্নি আসআলুকা মিন খাইরি হাজিহির রিহি ওয়া খাইরা মা ফিহা ওয়া খাইরা মা উরসিলাত বিহি, ওয়া আউযুবিকা মিন শাররিহা, ওয়া শাররি মা ফিহা ওয়া শাররি মা উরসিলাত বিহি’।

অর্থ : হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে প্রার্থনা করি এর কল্যাণ, এর মধ্যকার কল্যাণ এবং যা এর সঙ্গে প্রেরিত হয়েছে তার কল্যাণ। আর আমি আপনার আশ্রয় চাই এর অনিষ্ট থেকে, এর ভেতরে নিহিত অনিষ্ট থেকে এবং যা এর সঙ্গে প্রেরিত হয়েছে তার অনিষ্ট থেকে। (বুখারি, ৪/৭৬, হাদিস : ৩২০৬ ও ৪৮২৯)।