মমতাজ উদ্দিন আহমদ, আলীকদম
৪৭৪ কোটি ৪০ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মিত বান্দরবান জেলার আলীকদম-পোয়ামুহুরী সড়ক প্রকল্পের সুফল পেতে শুরু করেছে স্থানীয় জনসাধারণ। সড়ক নির্মাণের ফলে সীমান্ত এলাকার নিরাপত্তা জোরদারের পাশাপাশি দুর্গমে বসবাসকারী ম্রো, মার্মা, ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর সাথে বাঙ্গালীদের কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়েছে। পাশাপাশি বেড়েছে পর্যটনখাতের সম্ভাবনাও।
সড়কটির নির্মাণকাজ করে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কোর অব ইঞ্জিনিয়ার্সের ৩৪ ইঞ্জিনিয়ার কনস্ট্রাকশন ব্রিগেডের অধিনস্ত ১৬ ইঞ্জিনিয়ার কনস্ট্রাকশন ব্যাটালিয়ান (১৬ইসিবি)। এ প্রকল্পের সময়সীমা ছিল ২০২২ খ্রিস্টাব্দের ৩০ জুন। প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে ২০২২ খ্রিস্টাব্দের ৬ জুন সড়কের সম্পূর্ণ কাজ শেষ করেন বলে জানান প্রকল্প কর্মকর্তা মেজর মোঃ ইশরাকুর হক।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০১৭ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় আলীকদম থেকে পোয়ামুহুরী পর্যন্ত ৩৭ দশমিক ৫০ কিলোমিটার দীর্ঘ সড়কটি ৫ দশমিক ৫ মিটার প্রস্থে উন্নয়নের জন্য ৩৭৪ কোটি টাকা প্রাক্কলিত ব্যয়ে প্রকল্পটি অনুমোদিত হয়। সে সময় প্রকল্পের মেয়াদ ধরা হয় ২০১৭ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৯ সালের জুন পর্যন্ত।
২০১৯ সালে ৩৬.১৭ শতাংশ ব্যয় বাড়িয়ে অর্থাৎ ১৩৫ কোটি ২৮ লাখ টাকা বেড়ে প্রকল্পটির মোট ব্যয় ধরা হয় ৫০৯ কোটি ২৯ লাখ টাকা। প্রকল্পের শুরুতে ২০১৯ সালের জুনে বাস্তবায়নের কথা থাকলেও দুই বছর বাড়িয়ে করা হয় ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত। নির্ধারিত বরাদ্দের চাইতে ৩৫ কোটি টাকা কম খরচে সড়কটি নির্মাণ কাজ বাস্তবায়ন কাজ করা হয় বলে বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠান ১৬ ইঞ্জিনিয়ার কনস্ট্রাকশন ব্যাটালিয়ান (১৬ইসিবি)।
সরেজমিনের দেখা গেছে, বর্তমানে সড়কে নির্মাণাধীন কয়েকটি ব্রিজ ছাড়া সড়ক কার্পেটিং এর পুরো কাজ সমাপ্ত হয়েছে। আলীকদম উপজেলার দুর্গম পাহাড়ের মধ্য দিয়ে এ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করেছে সড়ক ও জনপথ অধিদফতর এবং স্পেশাল ওয়ার্কস অর্গানাইজেশন বাংলাদেশ সেনাবাহিনী।
আধুনিক নির্মাণ প্রযুক্তি ব্যবহার করে সড়ক নির্মাণ কাজটি বাস্তবায়ন করেছে বাংলাদেশ সেনা বাহিনী। সড়কটি নির্মাণে পাহাড়ের পর পাহাড়ের গা কাটতে হয়েছে। দেশের অন্যতম রিজার্ভ ফরেস্ট মাতামুহুরী সংরক্ষিত বনভূমির বক্ষভেদ করে খরস্রোতা মাতামুহুরী নদীর কিছুটা কুলঘেঁষে নির্মাণ করা হয় আলীকদম-পোয়ামুহুরী সড়কটি। তবে সড়ক নির্মাণের শুরুর দিকে বন বিভাগের বাধা ছিল প্রচুর। কিন্তু সেনা বাহিনী তা অগ্রাহ্য করে নির্মাণ কাজ এগিয়ে নিয়ে যায়।
সড়ক নির্মাণ কাজ শেষের দিকে হলেও পুরোপুরি সন্তুষ্ট নন পোয়ামুহুরী বাজারের ব্যবসায়ী ও ক্রেতাসাধারণ। তার কারণ হিসেবে জানা যায়, পোয়ামুহুরী বাজার থেকে ১ কিলোমিটার দূরে খেদারঝিরিতে শেষ হয়েছে সড়কের ৩৭ কিলোমিটার অংশ। প্রকল্পটির শেষের নাম ‘পোয়ামুহুরী’ হলেও ওই এলাকার বহুল পরিচিত ‘পোয়ামুহুরী বাজার’ স্পর্শ করেনি সড়কটি!
এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট মহলে আবেদন-নিবেদন করেও সুফল পাননি বলে জানান পোয়ামুহুরী বাজার ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি ফরিদুল আলম। তাদের আশা, শেষ পর্যন্ত পোয়ামুহুরী বাজারের সাথে সড়কের সংযোগ তৈরী করবে সেনাবাহিনী।
পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রেক্ষাপটে বড় এ প্রকল্পের প্রধান কার্যক্রমের মধ্যে ছিল ১৬ দশমিক ৯৭ লাখ ঘন মিটার সড়ক নির্মাণে হিল কাটিং, ৩ লাখ ঘন মিটার ব্যাকফিলিং অ্যাবান্টমেন্ট ও উইং ওয়াল, ৩৬ দশমিক ৫০ কিলোমিটার ফ্লেক্সিবল পেভমেন্ট নতুন নির্মাণ, ৯১৯ মিটার আরসিসি ব্রিজ ও ভায়াডাক্ট, ১২৫ মিটার আর্থ ওয়াটার ড্যাম, ৭২ মিটার আরসিসি বক্স কালভার্ট নির্মাণ, ৪২ মিটার ড্রপ স্ট্রাকচার, ৪৮ দশমিক ৩০ কিলোমিটার সাইড ড্রেন এবং ১১ হাজার ২৫০ বর্গ মিটার রোড মার্কিং।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০১৭ সালে একনেকে প্রকল্পটি পাশ হওয়ার পর পুনরায় ২০১৯ সালে ১৯ মার্চ প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভায় আলীকদম-পোয়ামুহুরী সড়ক নিয়ে বেশকিছু সুপারিশমালা প্রণয়ন হয়। পরে সেসব সুপারিশমালার ভিত্তিতে উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) পুনর্গঠন করা হয়।
এ সময় সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ সম্পূর্ণ সরকারি অর্থায়নে মোট ৫২৪ কোটি ৫৭ লাখ টাকা প্রাক্কলিত ব্যয় এবং ২০১৭ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২১ সালে বাস্তবায়নের জন্য প্রকল্পের প্রথম সংশোধিত প্রস্তাব পরিকল্পনা কমিশনে পাঠায়। এরপর ২০১৯ সালের ২৭ আগস্ট অনুষ্ঠিত একনেকের সভায় সংশোধিত প্রকল্প সুপারিশ উপস্থাপন শেষে ২০১৯ সালে ৩৬.১৭ শতাংশ বাড়িয়ে প্রকল্পটির মোট ব্যয় ধরা হয় ৫০৯ কোটি ২৯ লাখ টাকা।
সে সময় এ বিষয়ে প্রকল্পটির দায়িত্বপ্রাপ্ত পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগের সদস্য শামীমা নার্গিস পরিকল্পনা কমিশনের মতামত তুলে ধরেছিলেন এভাবে- ‘আলীকদম-জানালীপাড়া-করুকপাতা-পোয়ামুহুরী সড়কটি নির্মিত হলে সীমান্ত এলাকার নিরাপত্তা জোরদার, কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি এবং পর্যটন শিল্পের বিকাশে সহায়ক হবে।’
প্রকল্প সংশোধনের কারণ হিসাবে বলা হয়েছে, ‘প্রকল্পটি দূরবর্তী ও দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় অবস্থিত হওয়ায় পাথর ও অন্যান্য নির্মাণ সামগ্রী উৎস থেকে প্রকল্প এলাকায় পৌঁছানোর ক্ষেত্রে দুই বা ততোধিকবার যানবাহন পরিবর্তনসহ অতিরিক্ত লোডিং ও আনলোডিংয়ের প্রয়োজন হয়। এর ফলে প্রকল্পটির অন্যতম প্রধান নির্মাণ সামগ্রী পাথর ও বালুর মূল্য সড়ক ও জনপথ অধিদফতরের রেট শিডিউলের চেয়ে বেড়ে গেছে ‘
প্রকল্প সংশোধনীতে আরও বলা হয়, ‘প্রকল্প এলাকায় ভূমির প্রকৃতি অন্যান্য পাহাড়ি এলাকা হতে পৃথক হওয়ায় এবং প্রকল্প এলাকার বেশিরভাগ স্থানের মাটিতে পাথর মিশ্রিত থাকায় মাটি কাটার কাজটি অত্যন্ত কষ্টসাধ্য ও ব্যয়বহুল। এছাড়াও প্রকল্প এলাকার খাড়া ঢাল ব্যবস্থাপনার কারণে অতিরিক্ত মাটি প্রয়োজন। এর ফলে মাটির পরিমাণ ও ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রকল্পটি উঁচু-নিচু পাহাড় ও সংলগ্ন অপেক্ষাকৃত বেশি ঢাল বিশিষ্ট এলাকায় নির্মাণ করা হচ্ছে, যেখানে পানি সংগ্রহের উৎসগুলো অনেক দূরে অবস্থিত। দূরবর্তী স্থান থেকে পানি পরিবহন করার ফলে নির্মাণ ব্যয় বেড়েছে।’
আরও বলা হয়েছে, ‘শীতকালে মাতামুহুরী নদীতে পানি থাকে না। ফলে সড়ক নির্মাণে প্রয়োজনীয় পানি সংগ্রহ অত্যন্ত দুঃসাধ্য ও সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। এক্ষেত্রে কুরুপাতা ঝিরি, ক্রিল্লাইপাড়া ঝিরি, বালি ঝিরি, বড় বেটি ঝিরি ও ছোট বেটি ঝিরিতে নতুনভাবে চারটি ওয়াটার ড্যাম নির্মাণ প্রয়োজন। এ নতুন অংশটি ১৪ কোটি ৫২ লাখ ৫০ হাজার টাকা ব্যয় প্রাক্কলনসহ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। প্রকল্পটি দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় হওয়ায় এর নির্মাণ কাজ সঠিকভাবে শেষ করার জন্য প্রকল্পের মেয়াদকাল আরও একবছর বাড়ানো প্রয়োজন।
পরিকল্পনার কমিশিনের সুপারিশপ্রাপ্ত শেষোক্ত অংশটি অর্থাৎ ‘শীতকালে মাতামুহুরী নদীতে পানি থাকে না’, তাই ‘চারটি ওয়াটার ডেম নির্মাণ’ খাতে ১৪ কোটি ৫২ লাখ ৫০ হাজার টাকা ব্যয় প্রাক্কালনটি যথাযথভাবে সম্পন্ন হয়েছে তা প্রশ্নসাপেক্ষ। কুরুকপাতা ঝিরি ও বালি ঝিরিতে ওয়াটার ড্যাম নির্মাণ হলেও এত বিপুল পরিমাণ অর্থ সেখানে ব্যয় হয়েছে কিনা তা খতিয়ে দেখা দরকার বলে মনে করেন স্থানীয়রা।
কুরুকপাতা ইউপি চেয়ারম্যান ক্রাতপুং ম্রোর মতে, এ সড়কটি নির্মাণের ফলে সীমান্ত এলাকার নিরাপত্তা জোরদার, দুর্গমে বসবাসকারী ম্রো, মার্মা, ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর পাশাপাশি বাঙ্গালীদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। পাশাপাশি পর্যটন শিল্পের বিকাশ হবে বলে আশা তাঁর।
তিনি জানান, দেশের দক্ষিণপূর্ব অংশে বান্দরবান জেলার আলীকদম উপজেলার যোগাযোগ ব্যবস্থা অনুন্নত থাকায় সরকার এ প্রকল্পটি গ্রহণ করে। বিশেষ করে আলীকদম উপজেলার কুরুকপাতা ইউনিয়নটি শিক্ষা সুবিধা ও স্থাপনার অপর্যাপ্ততার কারণে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর স্বাক্ষরতার হার খুবই কম। ক্লিনিক, হাসপাতাল ও ডাক্তার না থাকার কারণে এ ইউনিয়নের মানুষ স্বাস্থ্যগত মৌলিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত। এ অবস্থার উত্তোরণে সরকার সেনাবাহিনীর মাধ্যমে ‘আলীকদম-পোয়ামুহুরী’ সড়ক নির্মাণ করে। এরফলে উন্নয়নের মূলস্রোতে এসেছে কুরুকপাতা-পোয়ামুহুরী এলাকার জনগণ।
প্রকল্প কর্মকর্তা ও ১৬ ইসিবির মেজর মোঃ ইশরাকুল হক জানান, সড়কের নির্মাণ কাজ আমরা নির্ধারিত সময়ের আগেই শেষ করতে সক্ষম হয়েছি। এ প্রকল্পের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল প্রকল্পর এলাকায় পর্যটন শিল্পের বিকাশকে সহজীকরণ, গ্রামীণ জনগণের কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরী, পার্বত্য চট্টগ্রামের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন। পাশাপাশি কৃষিজাত পণ্যের বিপনন, স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষার প্রসার এবং দুর্গম এলাকায় নিরাপত্তা অপারেশন বৃদ্ধি করা।
তিনি আরো বলেন, আলীকদম-জানালীপাড়া-কুরুকপাতা-পোয়ামুহুরী সড়ক এ অঞ্চলের পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর উন্নতির পাশাপাশি সুখী, সমৃদ্ধি, সুষম উন্নয়নের বাংলাদেশ গড়ার পথে এক বড় অর্জন।
আপনার মতামত লিখুন :